সমস্ত লেখাগুলি

অশৌচের নিয়ম কানুনেও ব্রাহ্মণদের সাথে অন্য বর্ণের এত ফারাক কেন? -
শম্ভুনাথ চার্বাক
May 20, 2025 | সামাজিক ইস্যু | views:3 | likes:0 | share: 0 | comments:0

পূর্বে  সমাজ ছিল প্রায় অনড় স্থির। জীবিকা অর্জনের উপায় ছিল খুবই সামান্য। সেই সময়ে বর্তমানের মতো মৃতের ডেথ সার্টিফিকেট এর ব্যবস্থা ছিল না। মৃতের উত্তরাধিকার  নির্ণয়ের জন্য সামাজিক শংসাপত্র ছিল সাদা থান পরিধান করে ঘোরা এবং লোককে জানান দেওয়া। সন্তানসম্ভবা মহিলার সাধ ও বাচ্চার অন্নপ্রাশন একই ধরণের অর্থাৎ আগামী উত্তরাধিকারীর পরিচিত ঘটানোর জন্য। ঐ সাদা থান পরিহিত ব্যক্তি দেখলেই বুঝি সেই ব্যক্তির পিতা বা মাতার বিয়োগ হয়েছে। যদিও  বর্তমানে কিছু মানুষ এই সাদা কাপড় ভিক্ষা  জীবিকা অর্জনের উপায় হিসেবে ব্যবহার করে। মৃতের জন্য মৃতের পুরুষ সন্তানদের অশৌচে ব্রহ্মচর্য পালন করতে হয়, নারীদের কোনও অধিকার নেই। অশৌচের ক’দিন একবেলা আতপ চালের মণ্ড কাঁচাকলা সেদ্ধ ও ফলমূল খেয়ে শরীরকে কষ্ট দিয়ে অতিবাহিত করতে হয়। ব্রাহ্মণরা কিন্তু দুধ-ঘি-মিষ্টি যোগে ভাল করে খায়। এখানেও ব্রাহ্মণদের সাথে অন্য বর্ণের লোকেদের ফারাক ছিল। 


আবার পালনের দিন সংখ্যাতেও অনেক ফারাক ছিল, যথা- ব্রাহ্মণ-১০ দিন,  ক্ষত্রিয় -১২ দিন,  বৈশ্য - ১৫ দিন, শূদ্র- ৩০ দিন অর্থাৎ সব থেকে গরীব যে শ্রেণী সেই শ্রমজীবী শূদ্র মানুষদের  কাজ থেকে বিরত রেখে কু-খাদ্য খাইয়ে শরীর শেষ করিয়ে এক্কেবারেই শেষ করে দেওয়ার রীতি। দুধে ভাতে থাকা ব্রাহ্মণদের এই কম দিনের সুবিধা কেন?  এই প্রশ্ন কোনও  শূদ্র করে না, শুধু গাধার মতো ভার বয়ে যায়। বর্তমানে সমাজ অনেক গতিশীল, বৃত্তির পরিবর্তন হয়েছে অনেক। পারিবারিক বৃত্তিতে থাকাও সবার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। এখন চর্মকারের পরিবারের সন্তান শিক্ষক ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হচ্ছেন আবার ব্রাহ্মণ সন্তান জুতোর/মাছের দোকান খুলে বসেছেন, বেয়ারা/ঝাড়ুদাড়ের কাজ করছেন। বৈদিক যুগে ঋক বেদের দশম মণ্ডলে জাতপাতের ভেদাভেদ দৃঢ় করা হয় এবং তখন থেকেই ভারতীয়দের পতন শুরু হয়। সমাজের এক বিশাল সংখ্যক মানুষকে শূদ্র নামে অভিহিত করে তাদের শ্রম চুরি করে, তাদের শিক্ষাঙ্গন থেকে বাতিল করে ক্ষত্রিয় শাসক ও সহযোগী ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের গুটি কয়েক পরিবার ধনী হয়ে ওঠে। 


গীতার অনেক শ্লোক এর পক্ষেই প্রচার করে এবং সরাসরি জাতপাতের ভেদাভেদকে সমর্থন করে। যাদের দমিয়ে রাখার জন্য এই প্রতিক্রিয়াশীল গ্রন্থগুলি তারাই গীতাকে মাথায় করে রাখে। মনুস্মৃতির মত প্রতিক্রিয়াশীল গ্রন্থ ব্রাহ্মণদের দ্বারাই রচিত শূদ্র ও অন্যান্য বর্ণের লোকেদের ওপর প্রভূত্ব করার জন্য। ভারতবর্ষকে পিছিয়ে দেওয়ার কারণও জাতপাতের ভেদাভেদ এবং নিয়তিবাদ। প্রতিবাদ ও ধ্বনিত হয়েছিল চার্বাকদের আন্দোলন ও পরবর্তীকালে বেদ বিরোধী বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের মানুষদের আন্দোলনে, ফলে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম কিছুটা স্তিমিত হলেও শৈব মতাবলম্বী গুপ্ত সম্রাটদের উত্থানে ও সহযোগিতাতে চতুর্থ শতকে পুণরায় সমাজ ব্রাহ্মণদের কুআচার কুসংস্কার অন্ধবিশ্বাসের দখলে চলে যায়। বাংলাদেশে শৈব মতাবলম্বী শশাঙ্কের উত্থান ও অত্যাচারে বৌদ্ধ ধর্মের অধঃপতন শুরু হয়। শশাঙ্ক নির্বিচারে বৌদ্ধ মঠ ধ্বংস করেন এবং বৌদ্ধ ভিক্ষুদের হত্যা করেন। এর ফলে ব্রাহ্মণদের কুআচারের শাসন বাংলাদেশেও শূদ্রদের গলা টিপে ধরে। সেন যুগে বল্লাল সেনের সহযোগিতাতে ব্রাহ্মণদের রমরমা চলতেই থাকে। মাঝে পাল যুগে বৌদ্ধদের আধিপত্য বজায় ছিল। অর্থাৎ শাসকের সহায়তা ভিন্ন ধর্ম এগোতে পারে না। পরবর্তীকালে ইংরেজদের আগমনে এবং পাশ্চাত্য শিক্ষার সংস্পর্শে এসে মানুষের চিন্তাভাবনাতেও পরিবর্তন আসে। ধনতন্ত্রের আগমনে সামন্ততন্ত্রের কুসংস্কার অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে প্রশ্ন ওঠা শুরু করে। যদিও ভারতবর্ষে পশ্চিম ইউরোপের মতো ধনতন্ত্রের স্বাভাবিক বিকাশ হয়নি। ইংল্যান্ডে ধনতন্ত্রের আগমনে জিওনার্দো ব্রুণো, কোপারনিকাস, গ্যালিলিও, স্ট্যুয়ার্ট মিল, চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদ এবং ভিক্টোরিয়ান সাহিত্যিকদের মানবিকতাবাদী  লেখনী ইউরোপিয়ান সমাজকে নাড়িয়ে দিলেও ভারতীয়দের  তেমন নাড়া দিতে পারেনি। বাংলার রেঁনেসাসে রামমোহন, ডিরোজিওর ইয়ং বেঙ্গল, বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার দত্ত, রবীন্দ্রনাথের প্রভাবে যুক্তিবাদী আন্দোলন প্রসার লাভ করলেও তা আবার  নবকৃষ্ণ দেব, রাধাকান্ত দেবেদের মতো সামন্ত প্রভুদের দখলে চলে যায় এবং ভাববাদের প্রসার লাভ ঘটে রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দদের মাধ্যমেই। সমাজ আবার কুসংস্কার অন্ধবিশ্বাসের আধার হতে শুরু করে। আর আমাদের বর্তমান শাসকদের বৈদিক আমলের ঐতিহ্যের গুণগান ও ক্রিয়াকলাপ দেখে বোঝা যায় সমাজে এরা আবার কুসংস্কার অন্ধবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে চায়। 


        এই গতিশীল সমাজে পিতা মাতার বিয়োগের পরে এতদিন ধরে অশৌচ পালন করলে শ্রমের যোগানে টান পড়বে এবং উৎপাদন হ্রাস পাবে এবং লোকেদের আর এই আচারে আবদ্ধ রাখলে ব্যবস্থার বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ শুরু হবে। তাই শ্রাদ্ধানুষ্ঠান এর আগে অশৌচের দিনের সংখ্যা কমিয়ে আনা হল। এখানেও পার্থক্য রয়ে গেল, ব্রাহ্মণদের ১০ দিন আর শূদ্রদের ১২ দিন। সব আচারের ব্যাপারেই ব্রাহ্মণরা সুবিধাভোগী। এটা নিয়ে কোনও শূদ্র প্রশ্ন করে না। আর বর্তমানে ডেথ-সার্টিফিকেট এর ব্যবস্থা আছে ঐ সাদা থান পরিধানের দরকার কি? ১২ দিন ধরে আচার পালন করে শরীরকে কষ্ট দেওয়ার অর্থ কী? এর ফলে নানান রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়। এই অপ্রয়োজনীয় প্রথাকে গাধার মতো শূদ্র ও অন্যান্য বর্ণের লোকেরা বয়ে নিয়ে চলেছে। শূদ্ররা ডিগ্রি অর্জন করলেও প্রকৃত শিক্ষা অর্জন করতে পারেনি। ফলে তাদের দাবিয়ে রাখার জন্য যে আচারের ব্যবস্থা ব্রাহ্মণদের দ্বারা সংঘটিত হয়েছে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে তারা ভয় পায়। ফলে এই শোষণ ব্যবস্থা এই দ্বাবিংশ শতকে মহাকাশে পাড়ি দেওয়ার যুগেও টিকে আছে। প্রখ্যাত সাহিত্যিক শিব্রাম চক্রবর্তী মস্কো থেকে পণ্ডিচেরী বইতে এই প্রথার বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ করেছেন। পুরোহিত  ব্রাহ্মণদের উনি নরখাদকের সাথে তুলনা  করেছেন। সমাজকে শোষণ করার জাতপাতের ভেদাভেদের ব্রাহ্মনীয় পদ্ধতি এক কথায় ইউনিক। অ্যাডাম স্মিথ বা স্ট্যুয়ার্ট মিল ও এগুলি ভাবতে পারেননি। চার্লস ডারউইন পড়া ডিগ্রি পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিতেরাও গাধার মতো এই ভার বয়ে চলেছে, এদের শিক্ষার সাথে জীবনের কোনও যোগ নেই। 


        মূল বাল্মীকির রামায়ণে দশরথের পুরোহিত জাবালিও রামচন্দ্রকে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করতে নিষেধ করেছিলেন। উনি বলেছিলেন কে দেখছে মৃত ব্যক্তি ফিরে আসে? রামচন্দ্র শাসকের প্রতিনিধি তিনি জাবালিকে তস্কর বৌদ্ধ বলে তিরস্কার করেছিলেন। অর্থাৎ রামায়ণ রচনা সমাপ্ত হয়েছিল বুদ্ধের আবির্ভাবের পরেই। বুদ্ধদেব তখন ব্রাহ্মণদের আচারের প্রতিবাদ শুরু করেছিলেন এবং বৌদ্ধ ধর্মে আত্মার কোনও সংস্থান রাখেননি। ফলে এই আচারগুলি রহিত হয়েছিল এটা বোঝা যায়। দুহাজার বছর আগের মানুষ এর প্রতিবাদ করলেও আধুনিক মহাকাশ যুগের মানুষ এর প্রতিবাদ করতে ভয় পায়।

           বাবা-মা জীবিত থাকাকালীন নিজের আর্থিক ক্ষমতা অনুযায়ী সেবা করুন; তবেই প্রকৃত শ্রদ্ধা দেখান হবে। আর বাবা-মাকে দেখলাম না, বাবা-মায়ের মৃত্যুর পরে নিষ্ঠাভরে আচার পালন করে বিশাল শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করলেও বাবা মাকে শ্রদ্ধা দেখানো যায় না। 

        

আত্মার ধারণাও বিদেশ থেকেই (ব্যাবিলন) ভারতে এসেছে বলে অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন। কে আত্মাকে দেখেছে? আসলে পরলোক ও আত্মার ব্যবসা না থাকলে ধর্মের গোড়া ধরে টান পড়বে। ইহলোকে অত্যন্ত কষ্টে থাকুন ওপরের তিন শ্রেণীকে সেবা করে যান বিনা প্রশ্নে তবেই পরলোকে আপনি দেবদেবীদের সাথে স্বর্গের পারিজাত বনে দ্রাক্ষা খেতে খেতে ইন্দ্রের ঐরাবতে করে ঘুরতে পারবেন। তাই এই আচার চলবে শাসকের সহযোগিতাতেই। শাসক মন্দির মসজিদ গির্জাতে ভোটের জন্য ঘুরে বেড়াবেন আর অবিরাম ধর্মের কুসংস্কার অন্ধবিশ্বাস ছড়িয়ে যাবেন।


সংগঠিত ধর্ম কোনওদিন ডারউইনকে পছন্দ করেনি -
শম্ভুনাথ চার্বাক
May 19, 2025 | বিবর্তনবাদ | views:3 | likes:0 | share: 0 | comments:0

জীব সৃষ্টি  হয়েছে কিভাবে? জীবকে সৃষ্টি  করেছে কে? এই প্রশ্ন মানুষের মনে নিরন্তর ঝড় তুলেছে সভ্যতার বিকাশের শুরুর সময়  থেকেই  বড় বড় বিশ্বমানবরাও দ্বিধাগ্রস্ত এই ব্যাপারে। ছোটবেলা থেকেই উঠতে বসতে ঘরে বাইরে শুনে আসছি সব তার   সৃষ্টি। অনেক অনেক প্রশ্ন এসেছে মনে, জিজ্ঞাসা করলেই বলত ডেঁপো ছেলে। প্রমাণের কি আছে হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ এবং তোমার পূর্ব পুরুষেরা বিশ্বাস করে আসছে, তোমাকেও তাই বিশ্বাস করতে হবে বিনা প্রশ্নেই। এসব বলেই দাবিয়ে দেওয়া হয়েছে, বেশী বললেই কখনও কখনও মার জুটতো কপালে। ধর্মের বিবর্তনের এবং ঈশ্বর গড আল্লাহদেরও বিবর্তন ঘটেছে এই পৃথিবীতে।  ব্যাবিলন সুমের মিশর আরব  নরওয়ে রোম গ্রীসের পেগান বা মূর্তিপূজকদের  দেবদেবীদের  ইহুদী খ্রিস্টান ও ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা  বিলুপ্ত করে দিয়েছে পৃথিবী থেকে। একমাত্র ভারতে উদ্ভূত পেগান বা মূর্তিপূজক ধর্মগুলি টিকে আছে দীর্ঘদিন ধরে। বড় ধর্মের  চাপ থাকলেও  আজও সারা পৃথিবীতে প্রায় ৪২০০ ধর্ম টিকে  আছে।  এই  প্রচলিত বৃহৎ  প্রাতিষ্ঠানিক  ধর্ম হিন্দু বৌদ্ধ  খ্রিস্টান ইসলাম ইহুদী সবাই  বলে তাদের নিজেদের  ঈশ্বর-গড-আল্লাহই সর্বশ্রেষ্ঠ। ঈশ্বরদের কোন সার্বজনিনতা নেই এবং সবাই একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী।  আবার সব ধর্মের প্রধান পুরুষ, কোন মহিলা নেই;  বেদের পুরুষ সুক্তে বলা হয়েছে সব পুরুষের  থেকেই সৃষ্টি।  এদের ঈশ্বর – গড – আল্লাহ  প্রত্যেকেই একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী এবং প্রত্যেকটি ধর্ম অপর ধর্মের ওপর আঘাত হেনেই বিকাশ লাভ করেছে এবং বারবার ধর্মের কারণে পৃথিবীকে রক্তাক্ত করেছে। ভারতে ব্রাহ্মণদের সাথে চার্বাক যুক্তিবাদীদের লড়াই;  হিন্দু বনাম বৌদ্ধ বা জৈনের লড়াই, শৈব শাক্ত বৈষ্ণবের লড়াই বাংলা দেখেছে মধ্যযুগে এবং হিন্দু মুসলিম খ্রিস্টানের লড়াইও দেখেছে, দেশভাগ দেখেছে ধর্মের কারণে, উদ্বাস্তু হওয়া দেখেছে ধর্মের কারণে।  রক্তাক্ত ক্রুসেড দেখেছে এশিয়ার ভূখন্ড। কোটি কোটি মানুষ মারা গেছে ধর্মের কারণেই। এরপরেও ধার্মিকরা বলেন ধর্ম  শান্তি দেয় চরিত্র গঠন করে ইত্যাদি ইত্যাদি।  সব কিছুই  ঈশ্বরের  সৃষ্টি।  ঈশ্বরের  এই সৃষ্টি তত্ত্বের  বিরুদ্ধে চার্লস ডারউইনের  বিবর্তনবাদ  তত্ত্ব  এক সপাটে চপেটাঘাত। এবারের  মেডিসিনে  নোবেলও  জিনের  বিবর্তনের কাজের  জন্যই।   বর্তমান  ভারতের শাসকবৃন্দ এবং ইসলামিক রাষ্ট্রগুলি  চায়না ডারউইনের বিবর্তনবাদ  শিক্ষার্থীদের  মাথাতে ঢুকুক তাই সিলেবাসের থেকে ডারউইন বাদ। এর বিরুদ্ধে লিখতেই এই প্রবন্ধ।

               চার্লস ডারউইন ইংল্যান্ডের অভিজাত পরিবারের সন্তান ছিলেন। নিজেও প্রচণ্ড ধর্মভীরু ছিলেন এবং ভবিষ্যতে ধর্মযাজক হওয়ার স্বপ্নও দেখতেন। কারণ ইংল্যান্ডে সেই সময় ধর্মজাজক হওয়া যথেষ্ট সম্মানের। কিন্তু জীব বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করার সময় জীব ও জীব সৃষ্টির জিজ্ঞাসা ডারউইনের কিশোর মনে ঝড় তুলেছিল প্রচন্ডভাবে। সেই ঝড়েই ডারউইনের জাহাজ বিগল গ্যালাপাগাস দ্বীপে অবতরণ করলো ১৮৩৫ সালের ২০ শে ফেব্রুয়ারী (১২ই  ফেব্রুয়ারী ডারউইনের জন্মদিন)।  ডারউইনের চিন্তা ভাবনাকে যেন উসকে দিতেই এইদিন চিলির উপকূলে নোঙর করা অবস্থায় তাঁদের জাহাজ এইচ এম এস বিগল কেঁপে উঠলো প্রবল এক-ভূমিকম্পে! দুই মিনিটের সেই ভূমিকম্প শেষে ডারউইন এবং জাহাজের ক্যাপ্টেন মহাবিস্ময় নিয়ে আবিষ্কার করলেন উপকূলের ভূমির উচ্চতা বেড়ে গেছে প্রায় আট ফুট! তাহলে কি লায়েলের Principle of Geology’র কথাই ঠিক? সব পরিবর্তনই কি প্রকৃতির খামখেয়ালিপনা করা শক্তিগুলোর ফলাফল?

১৮৩১ সালে জাহাজে ওঠার আগে ডারউইনকে তাঁর শিক্ষক এবং একইসাথে প্রখ্যাত বিজ্ঞানী প্রফেসর হেনেস্লো অপর এক প্রখ্যাত ভূতাত্ত্বিক চার্লস লায়েলের লেখা Principle of Geology বইটি উপহার দেন। গভীরভাবে ঈশ্বরে বিশ্বাসী হেনেস্লো কড়াভাবে ডারউইনকে বলে দেন যেন ভুলেও লায়েলের লেখাগুলোকে বিশ্বাস না করেন! কিন্তু ডারউইন জাহাজে যেতে যেতে প্রকৃতির খামখেয়ালীপনা দেখতে দেখতে গুরুর উপদেশ ভুলে গভীর সন্দেহে নিজেকে প্রশ্ন করতে শুরু করেন একের পর এক। কি ছিল লায়েলের সেই বইয়ে! লায়েল তাঁর বইয়ে বলেছিলেন, “নূহের আমলের এক কথিত মহাপ্লাবন দিয়ে পৃথিবীর ভূ-ভাগ রূপান্তরিত হয়নি। ভূভাগ বিবর্তনের অন্যতম কারণ হল বাতাস, বৃষ্টি, ভূমিকম্পের মতন অসংখ্য ছোটবড় প্রাকৃতিক শক্তি। এগুলোই অতীত থেকে বর্তমান সময়ে ভূভাগের পরিবর্তন ঘটিয়ে এসেছে এবং আসছে।” গুরুর কথা ভুলে ডারউইন তাই মনোনিবেশ করলেন আশেপাশের ভূপ্রকৃতির উপর এবং আস্তে আস্তে দীক্ষিত হয়ে উঠলেন লায়েলের সেই যুক্তিপূর্ণ রূপান্তরের মতবাদে। আর তার চাক্ষুষ প্রমাণ আজ পেলেন।

এই ভূমিকম্প নিয়ে ভাবতে ভাবতেই যাত্রাপথে আবার জাহাজে করে ঘুরতে ঘুরতে এসে পড়লেন ভার্ডে দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪৫ ফুট উঁচু একটি দ্বীপে। সেখানে দেখা গেল পাহাড়ের গায়ে এক রহস্যময় সাদা দাগ চলে গেছে মাইলের পর মাইল। পরীক্ষা করে জানা গেল রহস্যের তেমন কিছুই নেই, শামুক ঝিনুকের খোলের চুনাপাথরের ক্ষয়ই এই লম্বা দাগের রহস্য। কিন্তু শামুক ঝিনুক এতো উঁচুতে এক পাহাড়ের গায়ে এলো কিভাবে? তাহলে কি একসময় সেই পাহাড় লুকিয়ে ছিল সমুদ্রের জলের নিচে?

আর সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপারটি দেখা গেল গ্যালাপ্যাগাস দ্বীপপুঞ্জে নামার পর। এই দ্বীপপুঞ্জের বিভিন্ন দ্বীপ দেখতে দেখতে তরুণ ডারউইন দেখতে পেলেন বিভিন্ন প্রজাতির একগাদা ফিঞ্চ পাখি, যেগুলোকে আমরা ফিঙে নামে ডাকি। ডারউইন অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন সবগুলোই ফিঞ্চ পাখি হলেও অবাক করা জিনিস হলো এদের খাবারের প্রকৃতি অনুযায়ী বদলে গেছে এদের গঠন। যেমন যেগুলো গাছে থাকে তারা খায় একরকম খাবার, যেগুলো মাটিতে থাকে তারা খায় আরেকরকমের খাবার। খাবারের ধরন অনুযায়ী সেই পাখিগুলোর আকৃতিও বিশেষ করে চঞ্চু আলাদা! তিনি এই বৈচিত্র্য দেখতে দেখতেই এদের ১৩টি প্রজাতির বর্ণনা দেন, দেখান প্রজাতির বৈচিত্র্য। এই ১৩টির পর বর্তমানে আর একটিসহ মোট ১৪টি প্রজাতির ফিঞ্চ আমরা প্রকৃতিতে দেখতে পাই। এই পাখিদের দেখার পরেই তিনি প্রাথমিকভাবে সম্মত হলেন যে, বেঁচে থাকার প্রয়োজনেই জীবের মাঝে একেকরকম বৈশিষ্টের পরিবর্তন ঘটে এবং তারা ক্রমেই অভিযোজিত হয়ে তৈরি করে এক বা একাধিক নতুন প্রজাতি! সুতরাং প্রজাতি হল এমন কিছু জীবের সমষ্টি যারা শুধু নিজেদের মধ্যে প্রজননে সক্ষম। যেমন- আধুনিক মানুষ Homo sapiens sapiens প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত। অন্য কোন প্রজাতির সঙ্গে তারা কেউ প্রজনন করতে পারবে না!

ডারউইন আদতে এই তথ্যটি প্রকাশ করতে যথেষ্ট দ্বিধা করেছেন। কেননা তিনি নিজেও বুঝেছিলেন তাঁর দেওয়া মতবাদ কতটা বৈপ্লবিক। আরেক বিজ্ঞানী হুকারের কাছে লেখা চিঠিতে তাই তিনি লিখেছিলেন- নিজেকে তাঁর বড় একজন অপরাধী মনে হচ্ছে, তিনি যেন একজন নরঘাতক হিসেবে স্বীকারোক্তি দিচ্ছেন! তাই তত্ত্বের সত্যতা জেনেও কেবলমাত্র সন্দেহাতীতভাবে নিশ্চিত হতে তিনি আরও ২০ বছর ধরে গবেষণা করে লিখলেন জীববিজ্ঞানের ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত বই- The origin and Species by means of Natural Selection!!

ডারউইনের তত্ত্ব যে ভুল নয় তার প্রমান আমরা দেখতে পাই অন্যপ্রাণীদের মতন মানুষেরও অসংখ্য প্রজাতি আবিষ্কৃত হওয়ায়। এগুলোর মধ্যে হোমিনিড গণের অন্তর্ভুক্ত হোমো স্যাপিয়েন্স, হোমো ইরেক্টাস-সহ অসংখ্য প্রজাতির ফসিল আবিষ্কৃত হয়েছে। আবিষ্কৃত হয়েছে মানুষের মতন আরও অন্য এক প্রজাতি নিয়ান্ডারথালদের ফসিল। অনেক গবেষণার পর দেখা গেছে এক প্রজাতির বনমানুষ বা এপদের সঙ্গে মিলে গেছে আমাদের ডিএনের প্রায় ৯৮.৬%! ডারউইনের সময় কার্বন ডেটিং-সহ অনেক পরীক্ষার সুব্যবস্থা না থাকলেও এটা এখন পরীক্ষিত গবেষণাধর্মী সত্য যে, ৪০-৮০ লক্ষ বছর আগে একধরণের জাতি দুইপায়ে ভর করে দাঁড়াতে শিখলেও তাদের থেকে বর্তমান আমাদের অর্থাৎ আধুনিক মানুষের উদ্ভব ঘটেছে মাত্র দেড় থেকে দুইলক্ষ বছর আগে। এপর্যন্ত একটি ফসিলও পাওয়া যায়নি যেটি ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন মতবাদকে সমর্থন করে না। এমনকি মজার কথা হল ডারউইন পূর্ববর্তী সময়েও জর্জ বুফো, হাওয়ার, ওয়ালেস, উইঙ্গারসহ বেশকিছু বিজ্ঞানী ছিলেন যারা বুঝতে পেরেছিলেন প্রজাতি স্থির নয়, চলমান বিবর্তনের ফসল। কিন্তু এরা বিবর্তনকে মেনে নিলেও সেটি কিভাবে ঘটে তা কেউই ডারউইনের আগে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেননি। বিখ্যাত বিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্সের বহুল পঠিত Ancestor’s Tale বা আশির দশকে ড. টিএম বেড়ার লেখা Evolution and Myth of Creationism কোনওটিই ডারউইনের বিবর্তনবাদ অতিক্রম করেনি, বরং সমর্থন যুগিয়েছে বহুগুনে। ডকিন্স তাঁর প্রতিটি লেখায় তুলে এনেছেন বিবর্তনবাদের মৌলিকত্বকে। তিনি বারবার বলেছেন - এখন পর্যন্ত একটি ফসিলও ভুল জায়গায় আবিষ্কৃত হয়নি যেটি বিবর্তনবাদকে ভুল প্রমাণ করতে পারে!

বিজ্ঞান গতিশীল, যে গতিশীলতা প্রজাতিগুলোর পারস্পারিক সম্পর্ক নির্দেশ করে। হাজার বছরের বিশ্বাসকে লালন করার নাম বিজ্ঞান নয়, বিশ্বাসকে যুক্তিপূর্ণভাবে ব্যবচ্ছেদ করা এবং তার সত্যতা বা মিথ্যাচারকে সত্যের আলোকে উন্মোচন করাই বিজ্ঞানের কাজ। ডারউইনবাদ আর বিবর্তন এতটাই প্রমাণিত যে সেটি ঘটেছে কি ঘটেনি তা নিয়ে সন্দেহের কোনওই অবকাশ নেই। 


হাজার হাজার বছর ধরে ঈশ্বর আশ্রিত ভাবনা ঝেড়ে ফেলতে পারেননি  ডারউইন , বিজ্ঞান নিয়ে চর্চা না করলে হয়ত যাজকই হতেন বা ধর্ম তত্ত্বের অধ্যাপক হতেন , আবার মন থেকে জীব সৃষ্টির সেই ঈশ্বরের তত্ত্ব মেনে নিতেও পারেননি ডারউইন।হাজার হাজার বছর ধরে যে ধর্ম ঘিরে রয়েছে পৃথিবীকে (থুড়ি পৃথিবী বললে ভুল হবে এশিয়া-আরব-ইউরোপকে। কারণ আমেরিকা ওসেনিয়া মহাদেশের কথা কোনও প্রাতিষ্ঠানিক  ধর্মগ্রন্থতে ছিলনা । ১৫২৬ সালের আগে আমেরিকায় সভ্য মানুষের পদার্পন ঘটেনি। শেষ সংগঠিত ধর্ম ইসলামের জন্ম ৬০০ সাল নাগাদ। ডারউইন ধর্মের আলোকে জীবের সৃষ্টির  উত্তর পাওয়ার জন্য বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ পাঠ করলেন, কিন্তু অশান্ত মনকে শান্ত করতে পারলেন না। পরবর্তী সময়ে বিখ্যাত ইংরেজ দার্শনিক জন লকের বিখ্যাত উক্তি “বস্তু থেকে চেতনার উদ্ভব” আবার তাঁকে অশান্ত করে তুলল। সুযোগ পেলেন জীব বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করার, চাপলেন বিগল নামের জাহাজে গ্যালাপাগাস দ্বীপে যাওয়ার জন্য।  গ্যালাপাগাস দ্বীপে তিনি বিভিন্ন জীবজন্তুর সন্ধান পেলেন এবং হাজার  হাজার জীবাশ্মের সন্ধান পেলেন, প্রায় ২৫০০০ জীবাশ্ম পাঠিয়ে দিলেন ইংল্যান্ডে। দীর্ঘদিন সেগুলি পরীক্ষা করে সিদ্ধান্তে এলেন জড় পদার্থ থেকেই জীবের উৎপত্তি এবং তার ক্রমবিকাশের শেষ পর্যায়ে  মানুষের উৎপত্তি। তিনি লিখলেন  “the origin of species by means of natural selection,of the preservation of favoured  races in the struggle for life” এই বইটা বেরোনোর সাথে সাথে সংগঠিত ধর্মের বিকৃত মানুষেরা প্রতিক্রিয়া দিতে শুরু করলো। কোপারনিকাস, গ্যালিলিও, জিওনার্দো ব্রুনোর পর ডারউইনের এই আঘাতে প্রবল  প্রতিক্রিয়া প্রত্যাশিতই  ছিল। ইংল্যান্ডের ধর্মান্ধ ব্যক্তিরা তাঁকে নানানভাবে অপদস্থ করা থেকে  প্রাণে মারতেও  চাইলেন। শুধু প্রাণে মারতে পারেনি কারণ ডারউইনের সমর্থনে ঈংল্যান্ডের কিছু বিখ্যাত অভিজাত পরিবারের মানুষ দাঁড়িয়েছিলেন। (আমাদের দেশের বিখ্যাত চিকিৎসক সুশ্রুতের শল্য চিকিৎসা যখন  ব্রাহ্মণদের নেতা যাজ্ঞবল্ক বন্ধ করে দিলেন তখন কিন্তু তিনি  কারো সমর্থন পাননি, নয়তো ভারত আজ  চিকিৎসা শাস্ত্রে অনেক দূর এগিয়ে যেত)  এদের মধ্যে  বিশেষ করে উল্লেখ করতে হয় টমাস হাক্সলি, শল্য চিকিৎসক ডাঃ ওয়েনের কথা। টমাস হাক্সলিকে ডারউইনের ডালকুত্তা নামেও  অভিহিত করা হয়।


দর্শনের যে মূল সংঘাত সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন ডারউইন। ধর্মে জীব সৃষ্টিতে ঈশ্বর আছেন। কিন্তু ডারউইনের বইতে সৃষ্টিকর্তা হিসাবে ঈশ্বর  নেই আছে “প্রকৃতি ও পরিবেশ”। ঈশ্বরের ঠাই নেই সেখানে। সেসময় ডারউইনকে কি পরিমাণ আক্রমণ  হজম করতে হয়েছিল নীলকন্ঠ হয়ে তা এখন  ভাবা যায় না। এই ধর্মান্ধ কীটেরা কি ভয়ানক তা  আজ পাকিস্তান বাঙলাদেশের আমাদের মত উদ্বাস্তুরা  ও মুক্তমনারা জানে, জানে অভিজিত রায়, রাজিব, ওয়াশিকুর, নাজিমুদ্দিন, নিলয় বা আমাদের দেশের দাভালকার-পানেসর-কালবুর্গী-খলিল-গৌরি লঙ্কেশ। সারা আরবের  সিরিয়া, জর্ডন, ইরাক, তুরস্কের উদবাস্তুরা জানে, পাকিস্তান, আফগানিস্তানের উদ্বাস্তুরা জানে। এই সব উদ্বাস্তুদের তথাকথিত কোন ঈশ্বর–আল্লাহ-গডেরা রক্ষা করে না। আমেরিকাতে ডারউইনের বিবর্তনবাদ পড়ানোর জন্য শিক্ষকের শাস্তি হয়েছিল, যা মাঙ্কি ট্রায়াল নামে সারা পৃথিবীতে  খ্যাত। 


আমার মনে হয় পৃথিবীতে অনেক প্রখ্যাত পদার্থ বা রসায়ন  বৈজ্ঞানিক অনেক গুরুত্বপূর্ণ  কাজ করেছেন, সভ্যতাকে এগিয়ে দিয়েছেন অনেকদূর। কিন্তু বিজ্ঞানের কাজের প্রভাব বিজ্ঞান ছাড়িয়ে সমাজ, ধর্ম, শিল্প, সংস্কৃতি ও রাজনীতির জগতকে সব থেকে আলোড়িত করেছিল চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদ। ডারউইনের উপর সারা পৃথিবী জুড়ে সংগঠিত ধর্মের   একের পর এক আক্রমনই এর সব থেকে বড় প্রমাণ। একারণেই সংগঠিত ধর্ম কোনওদিনই ডারউইনকে পছন্দ করেনি বরং বিরোধীতা করেছে। তাই হিন্দু মুসলিম খ্রিস্টান মৌলবাদীদের দ্বারা ডারউইনকে মুছে ফেলার  প্রচেষ্টা হবে সেটাই স্বাভাবিক।  এইজন্যই সিলেবাস থেকে ডারউইন বাদ।  এরা সবাই ধপাস তত্ত্বে বিশ্বাসী।

কোরানে আল্লাহকে কি নবি মুহাম্মদের থেকে পৃথক করা যায়? -
শম্ভুনাথ চার্বাক
Nov. 27, 2024 | ধর্ম | views:822 | likes:2 | share: 2 | comments:0

নবি ছিলেন মক্কার কুরাইশদের হাসমি গোষ্ঠীর লোক।  ছোটবেলা থেকেই ছিলেন ভাবুক। বাবা মারা যাওয়ার পর মরুভূমির ঊষর প্রান্তরে অন্যের উট চরাতে চরাতে নিজের দুর্দশার কথা ভাবতেন। তার ধনী কাকারা তার দায়িত্ব নেননি। আবার এক চাচা আবু লাহাব মুহমুহাম্মদের উপর ছিলেন ভীষণ খাপ্পা ফলে নবির পয়লা নম্বর শত্রু। নবির পূর্বপুরুষেরা সবাই পৌত্তলিকতায় বিশ্বাসী। নবির পৌত্তলিক দেব দেবীদের উপর রাগ বিদ্বেষের কারণ তার বাবা মারা যাওয়ার পর তার ধনী  চাচারা নবিকে দেখেননি। আর এই চাচারা কাবা ঘরের দেবদেবীদেরকে কেন্দ্র করেই  ব্যবসায় ফুলে ফেঁপে উঠেছেন। ফলে এই দেবদেবীদের প্রতি রাগ অবিশ্বাস আর মক্কার  নির্জনে পারস্য ও গ্রীকদেশীয় উপকথা শুনতেন এবং  ইহুদী ও খ্রিস্টান পুরোহিতদের সাথে একান্ত আলোচনায় একটা অবসেশান বা ঘোরের মধ্যে পড়েন। এর ফলে একেশ্বরবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে নতুন আল্লাহর সৃষ্টি করেন, এবং নিজেকে মুশা বা ঈশার মত রসুল কল্পনা ভাবতে থাকেন। প্রশ্ন হচ্ছে, নবি যদি কাবাঘরের পরিচর্যা করে তার চাচাদের মতো কাবা ঘরের আয়ের ভাগ পেতেন তবে কি তিনি নতুন ধর্মের প্রবর্তন করতেন? নবি অবশ্যই এক বিশাল কৃতিত্বের অধিকারী, একদম নিঃস্ব অবস্থা থেকে এক বিশাল আরবীয়ান সাম্রাজ্যের স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং তার সার্থক রূপদান করেছেন ধর্মের আশ্রয়ে। তার সৃষ্ট ইসলাম আজ পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম। এই ধর্মের প্রধান হচ্ছে আল্লাহর বাণী (ওহি)  সংবলিত কোরান এবং যে ধর্মীয় আচরণগুলি কোরানে নেই  কিন্তু নবি পালন করতেন সেগুলিকে সুন্নাহ বলে। এবং সেগুলোর লিখিত রূপ  হাদিস। নবির মৃত্যুর পরে লক্ষ লক্ষ হাদিস লেখা হয়েছে। বর্তমান সৌদির রাজপুত্র প্রিন্স সলমন নবির মৃত্যুর পর লেখা সব হাদিস বাতিল বলে ঘোষণা করেছেন। প্রায় প্রতিটি ডিগ্রীধারী অশিক্ষিত নিরক্ষর মুসলমান বিশ্বাস করে কোরানের প্রতিটি বাণী আল্লাহ প্রেরিত প্রত্যাদেশ বা ওহি, কোনও মানুষের রচিত নয়। যেমন বড় বড় ডিগ্রীধারী অশিক্ষিত হিন্দুরাও মনে করে বেদ অপৌরুষকার।  আল্লাহর পাঠানো ওহি গুলিই আল্লাহর রসুল  মুহাম্মদের মুখ দিয়ে বেরিয়েছে। যদিও সেই সময়েই আয়েশার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল আপনার আল্লাহ তো আপনার সুবিধার্থে ওহি পাঠাতে বিশেষ দেরী করেন না।   

কোরানে আল্লাহর সর্বোৎকৃষ্ট ও সদ গুণাবলীর উল্লেখ আছে। তিনি সমস্ত যুক্তিবুদ্ধির সীমাকে  অতিক্রম করে গেছেন। তিনিই আকাশের তারকারাজির মালিক, তিনি ছয়দিনে সপ্ত আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। তিনিই মেঘ বৃষ্টিপাত বজ্র ঝড়ের স্রষ্টা। তিনি তার নিদর্শন দেখাতে নবিকে নিয়ে মেরাজে করে সপ্ত আকাশ ভ্রমণ করান এবং হাজার কিমি দূরবর্তী দুই মসজিদ ভ্রমণ করান এক রাত্রের মধ্যেই, এ যেন ধনী ব্যক্তি আল্লার তার দরিদ্র আত্মীয়  মুহাম্মদকে ঐশর্য্য প্রদর্শন করাচ্ছেন। কোরান বেশ কিছু জায়গায়   গ্রীক উপকথা ও বাইবেলের ৫০%  জেরক্স কপি হলে ও নবির প্রতি আল্লাহ আরও বেশি স্নেহপরায়ণ। কিন্তু সমগ্র কোরান খুঁটিয়ে পড়লে দেখা যায় আল্লাহর পাঠানো প্রত্যাদেশ বা ওহিগুলি  বেশ কিছু জায়গায় সাংঘর্ষিক এবং সব জায়গাতেই মুহাম্মদ এর সুবিধাভোগী এবং সব থেকে আশ্চর্যের যেটা এই ওহিগুলির বক্তা কে মুহাম্মদ না আল্লাহ তা পরিষ্কার বোঝা যায়। এই নাজিল করা ওহিতে এক কথা বলছেন এবং পরেক্ষণেই ঠিক এর বিপরীত ওহি নাজিল করছেন। আর বেশ কিছু সুরার এমন সব আয়াত আছে যেগুলি পড়লে মনে হয় মুহাম্মদের নিজের বক্তব্য, কিছুতেই আল্লাহর প্রত্যাদেশ হতে পারেনা তা বাক্যের গঠন দেখলেই বোঝা যায়। মুহাম্মদ এভাবেই সারা কোরান ধরে নিজের বক্তব্য আল্লাহর নামে চালিয়েছেন। একটা উদাহরণ দিচ্ছি ------- সুরা আ-বাসা থেকে, আয়াত ১৩- ১৬ 

পরম করুণাময় পরম দয়াময় আল্লাহর নামে,

সমস্ত প্রশংসা বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লারই,

যিনি পরম করুণাময়, পরম দয়াময় বিচার দিনের মালিক,

আমরা একমাত্র তোমারই উপাসনা করি, 

তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি,

তুমি আমাদেরকে সঠিকভাবে চালিত কর সঠিক পথে

তাদের পথে যাদের তুমি অনুগ্রহ দান করেছ,

যারা তোয়ার রোষে পতিত হয়নি,পথভ্রষ্টও হয়নি।

এইটা কি আল্লাহর ওহি বা প্রত্যাদেশ হতে পারে? আল্লাহ কি নিজেই নিজের গুণগান করছেন? আল্লাহ কি নিজে নিজের উপাসনা করছেন বা করবেন? মোহের দ্বারা যারা আচ্ছন্ন নয় তারা এর সত্য মিথ্যা বুঝতে পারেন। এখানে নবিই আল্লাহ আর আল্লাহই নবি। আর যারা ধর্ম মোহের দ্বারা আচ্ছন্ন তাদের কাছে কোরান ঐশী বাণী। ৯৯% মুসলমান কোরান পড়েন না, পড়লেও নিজেদের মস্তিষ্ককে বন্ধক দিয়ে আসেন মসজিদের ইমাম মুমিনদের কাছে। 

      সমগ্র কোরানের বেশকিছু আয়াত সাংঘর্ষিক। কোরানে আল্লাহ যুক্তিবুদ্ধির সীমা অতিক্রম করে গেছেন। সেখানে আল্লাহ ও বিভ্রান্ত, এই এক আয়াতে এক কথা আর কিছু পরেই তার বিপরীত কথা। কোরানের সব থেকে বেশী সুবিধাভোগী মুহাম্মদ। নবি ভাল মন্দ যা করেছেন তার সব কাজের শিলমোহর দিয়েছে কোরান। আল্লাহ মুহাম্মদের বিপরীত মতের লোকদের জন্য খড়্গহস্ত আর নবির জন্য পরম দয়ালু। নবীর অতিরিক্ত যৌন ক্ষিদে মেটানোর জন্য বিবিদের সাথে দ্বন্দ্ব হলেও আল্লাহ আয়াত নাজিল করেন নবির পক্ষেই। সংসারের মেয়েলি ব্যাপারেও তিনি  এত আয়াত নাজিল করেছেন (সুরা তাহরিম / আহজাব) তাতে আশ্চর্য হতে হয়। নবির লুঠতরাজ এবং বানু কারজাই গোষ্ঠীর ইহুদীদের  নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিও সমর্থন জানিয়ে আল্লাহ নবির পক্ষেই আয়াত নাজিল করেন। গণিমতের মালের বন্টনেও আল্লাহ নবির পক্ষে, নবির অংশ  ১/৫ ভাগ, বাকি মাল অন্যেরা ভাগ করে নেবে। সেখানেও নবিই সব থেকে বেশী সুবিধা প্রাপক। 

      আল্লাহর বক্তব্য কিভাবে সাংঘর্ষিক তার কিছু উদাহরণ কোরান থেকেই দেওয়ার চেষ্টা করছি। কোরানে আল্লাহ সর্বস্রষ্টা, সর্বজ্ঞানী, সবজান্তা, সর্বশক্তিমান, সর্বদ্রষ্টা, সর্বশ্রোতা, সব অভাব থেকে মুক্ত, করুণাময়, কর্তৃত্বব্যাঞ্জক, ক্রুদ্ধ, অভিশাপদাতা, হুমকি প্রদানকারী এবং ছলনাকারী (সুরা আনফাল ঃ আয়াত ৩০) ও প্রতিশোধ পরায়ণ (সুরা সাজদাহ্ আয়াত ২২, সুরা জুকরফের ৪১ ও ৫৫ নং আয়াত)। আবার আল্লাহ পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু (১২ঃ ৯২)। আবার কেউ তার সাথে শরিক করলে তা হবে সম্পূর্ণ ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ (৪ঃ১১৬)। তিনি তার বান্দাদের প্রতি অবিবেচক হবেন না (৫০ঃ২৮)। অথচ দোজখের আগুনে পুড়িয়ে শাস্তি দেন। তিনি বলেন যখনই অবিশ্বাসীদের চামড়া দোজখের আগুনে পুড়ে যাবে তখনই আবার নতুন চামড়া জন্মাবে যাতে তারা অনন্তকাল কঠোর শাস্তি পেতে থাকে (১৮ঃ৫৫)। আল্লাহইতো সব বিশ্বাসী বা অবিশ্বাসীদের স্রষ্টা, তাহলে উনিতো সবাইকে বিশ্বাসী করেই পাঠাতে পারতেন। তা না করে অবিশ্বাসীদের শাস্তি দেবেন কেন? মূল দোষী কে এখানে অবিশ্বাসী না আল্লাহ?

পরম সৃষ্টিকর্তা আল্লাহতায়ালা যাকে ইচ্ছা পথ প্রদর্শন করেন আর যাকে ইচ্ছা বিভ্রান্ত করেন (১৮ঃ১৭)। আবার পরেরক্ষণেই যারা বিভ্রান্ত হবে তাদেরকে কঠোর শাস্তি প্রদান করা হবে। সুরা বাকারার ১০ ও ৯০ নম্বর আয়াত/ সুরা মায়িদার ৯৪ নং/সুরা তওবার আয়াত ৩৯। প্রশ্ন হচ্ছে আল্লাহ নিজেই বিভ্রান্ত করবেন আবার নিজেই কঠোর শাস্তি প্রদান করবেন? বিভ্রান্ত হওয়ার দায় কার?

একদিকে আল্লাহ সর্বশক্তিমান, আবার এক আয়াতে তার সাহায্যের প্রয়োজন হয়। (সুরা সাফফ, আয়াত ১৪)। মরিয়মের সন্তান ঈশা ----- আমরা ঈশ্বরের সাহায্যকারী। বা আমি মানুষের জন্য লোহা নাজিল করেছি যাতে মানুষের জন্য মহাশক্তি ও উপকার রয়েছে যাতে অদৃশ্য আল্লাহ জানতে পারেন কে তাকে ও তাঁর রসুলকে সাহায্য করেছেন? (সুরা আল হাদিদ – আয়াত ২৫)। যিনি সর্বশক্তিমান তিনি কী করে নগণ্য মানুষের সাহায্য চান? সর্বশক্তিমান কী করে নগণ্য আবু লাহাবের (মুহাম্মদের চাচা) মাথায় বজ্রপাতের অভিশাপের আয়াত নাজিল করেন? অদ্ভুত লাগে শত্রু কাকা  নগন্য আবু লাহাবের প্রতি এত বিদ্বেষ যে আল্লাহ   আবু লাহাবের নামে আল্লাহ একটা সুরা নাজিল  করে পাঠালেন? নগণ্য আবু লাহাবের নামে একটা সুরা পর্যন্ত নাজিল হয় কেন? আবু লাহাবের স্ত্রী পর্যন্ত এই অভিশাপ থেকে বাদ যায়নি। শক্তিমান লোকেরা কি নগণ্য লোকদের অভিশাপ দেন? পুটিন ইউক্রেন আক্রমণ করে সঠিক না বেঠিক করেছেন সে প্রসঙ্গে যাচ্ছি না। উনি কি জেলেনেস্কিকে অভিসম্পাত করছেন? সুরা বালাদে ও সুরা হুমাজার (১০৪ নং আয়াতে) ওয়ালিদ আল মুগিরা এবং উমাইয়া বিন খালিদের প্রতি একই ধরণের হুমকিপূর্ণ অভিশাপ। কারণ মুহাম্মদের দুইপুত্র কাশেম ও তাহের মারা যাওয়ার পর ওয়ারেল মুহাম্মদকে লেজকাটা (উত্তরাধিকারহীন) বলে ঠাট্টা করেছিলেন। এছাড়া নবি আল্লাহর রসুল, আল্লাহ নবির ছেলে কাশেম তাহেরকে বাঁচাতে পারলেন না? 

বদরের যুদ্ধের পর কাব বিন আশরাফ নামে ইহুদী কবি হেরে যাওয়া পৌত্তলিকদের প্রতি সমবেদনা দেখালে এবং তাদের মুহাম্মদের উপর তাদের স্থান দিলে আল্লাহ ক্রুদ্ধ হয়ে সুরা নিসার ৫১-৫৭ আয়াত নাজিল করলেন। আবার সুরা হাশরেনবি যখন বানু নাজির নামে ইহুদী গোষ্ঠীকে হত্যা করে নির্মূল করলেন তখনও আল্লাহ নবির কাজের প্রশংসা করে হত্যাকারী নবির পক্ষে সমর্থন করে আয়াত নাজিল করলেন সুরা বানু নাজিরে।

আল্লাহ সারা ব্রহ্মান্ডের মালিক, তাঁর ইচ্ছা ছাড়া গাছের পাতা নড়ে না। কিন্তু আল্লাহ সব সময়েই নবির পক্ষে। নবির উদ্দেশ্য বাস্তয়ায়নে বাধা দানকারীদের তিরস্কার করেছেন। যুদ্ধে জিতলে আল্লাহ জিতিয়েছেন আর যুদ্ধে নবি হারলে তিনি নিশ্চুপ। একদম সাধারণ কামুক মানুষের মতো কামুক নবি যৌনতা নিয়ে কুড়ি জন স্ত্রীদের সাথে সমস্যায় পড়লে মধ্যস্ততা করে নবিকে সুবিধা পাইয়ে দিয়েছেন। নবি পালিত পুত্র জায়েদের সুন্দরী স্ত্রী জয়নাবের সাথে বিয়ের ব্যবস্থা করেছেন আয়াত নাজিল করে। সুরা আহজাব/ সুরা তাহরিম এর সাক্ষ্য বহন করে। 

           আল্লাহ এই মহাবিশ্বের মালিক হলেও তিনি   হিজরি ১-১১ হিজরি (৬২২-৬৩২ খ্রী) আল্লাহ নবির সাথে আরবের হেজাজ ও নেজদ অঞ্চলে বসবাস করতেন। বিশ্বের অন্য অঞ্চলের কথা ভুলে গিয়েছিলেন। কোরানে ইউরোপ আমেরিকা অষ্ট্রেলিয়া বা ভারতীয় উপমহাদেশ ও দঃপূর্ব এশিয়ার কথা নেই। কারণ নবির এই মহাদেশগুলির সম্পর্কে কোনও জ্ঞান ছিল না। আর আমেরিকা মহাদেশ আবিষ্কার হয়েছে ১৫২৬ সালে। 

নবি সবাইকে আল্লাহর পক্ষে যুদ্ধে যাওয়ার (জিহাদের) জন্য আরবীয়ানদের প্ররোচিত করেছেন। যা বর্তমানের মৌলবাদী মুসলিম সংগঠনগুলি করে। মুসলিমদের মধ্যে এইরকম ধর্মীয় শিক্ষার জন্যই টেরোরিস্ট বেশি। এটা   ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার জন্যই নবির শিক্ষা।  যুদ্ধে অংশগ্রহণে অনাগ্রহ বা শৈথিল্য দেখালে তাদের দোজখের লেলিহান শিখার ভয় দেখিয়েছেন। আর যারা জিহাদে গেছে তাদের জন্য জান্নাতের তলদেশে নহর প্রস্তুত করিয়েছেন। এগুলো যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে পাঠ করলে নবি মুহাম্মদের সাথে আল্লাহর ফারাক করতে পারবেন?

নবির প্রতি কেউ উপহাস করলেও সঙ্গে সঙ্গে সুরা হিজরের ৯৫ নং আয়াতে নবিকে স্বান্তনা দেওয়া হল --- যারা বিদ্রুপ করে তাদের বিরুদ্ধে তোমার জন্য আমিই যথেষ্ট। সুরা আনফালের প্রায় পুরোটা জুড়ে বদরের যুদ্ধে মহান আল্লাহর গুণগান ও ভূমিকার কথা। আল্লাহ ফিকেল মাইন্ডেড, কারণ একটা আয়াত নাজিল করেই আবার পরেরক্ষণেই এর বিপরীত আয়াত নাজিল করেন। যেমন দেশের শত্রু নিপাত সম্পূর্ণভাবে না করা পর্যন্ত বন্দী রাখা কোনও নবির পক্ষে সমীচীন নয় (আয়াত ৮ঃ৬৭)। কিছু পরেই আবার আয়াত (৮ঃ৭০) বলা হল, যুদ্ধবন্দীদের থেকে মুক্তিপণ আদায় করে মুক্ত করে দেওয়া হবে। মাত্র তিন আয়াতে পরিবর্তন, আল্লাহ বেশ খামখেয়ালী কিন্তু। যুদ্ধে জিতলে আল্লাহর অনুগ্রহে জিতেছেন। পরিখা বা খন্দকের যুদ্ধে বিজয়ের পর আল্লাহর গুণগান করে প্রচুর আয়াত নাজিল হয়। কিন্তু ওহুদের যুদ্ধে যখন মুসলমানদের শোচনীয় পরাজয় হয় এবং নবির প্রিয় চাচা হামজা বিন আব্দুল মোতালেব সহ সত্তর জন সাহাবি মৃত্যুবরণ করেন তার সম্পর্কে আল্লাহ নিশ্চুপ, এখানে আল্লাহর কোনও দায় নেই। 

আল্লাহর মহাবিশ্ব যেন হেজাজে নেমে এসেছিল। কোরানের একাধিক আয়াতে হেজাজের সামাজিক অবস্থার বর্ণনা আছে। বিভিন্ন ঘটনা ও সংঘাত, বিতর্ক, রটনাকারীদের জবাব, ব্যক্তিগত ঝগড়ায় মধ্যস্ততা, মেয়েলি ব্যাপার, যুদ্ধের জন্য সনির্বন্ধ আহবান, মুনাফেকদের নিন্দা, যুদ্ধলব্ধ গণিমতের মাল, নারীর প্রতি নির্দেশ এবং অবিশ্বাসীদের দোজখের আগুনের হুমকি দিয়ে শত শত আয়াত আছে। 

কোরানে স্রষ্টার মানবসুলভ গুণাবলী আছে। আল্লাহর রাগ, খুশী আনন্দ, ভালবাসা, প্রতিহিংসাপরায়ণতা, ষড়যন্ত্র করা, ছলনা, অভিসম্পাত করা, হুমকি দেওয়া সহ মানুষের সমস্ত গুণাবলী আছে। আসলে মানুষ নবি মানুষের আদলেই আল্লাহকে সৃষ্টি করেছেন। এটাই স্বাভাবিক মানুষ তার নিজের আদলেই ঈশ্বরকে সৃষ্টি করে। আমরা অতীব ক্ষুদ্র মানব, আমরা আশা করব মহাবিশ্বের স্রষ্টা নগণ্য মানুষের দোষগুণ থেকে মুক্ত থাকবেন। কিন্তু কোরান এর বিপরীত সাক্ষ্য দেয়। সেখানে নবিকে আর আল্লাহকে ফারাক করা যায় না।

 গরীব নিরক্ষর অশিক্ষিত অল্প শিক্ষিত মানুষকে ধর্মের ওপরের অংশের লোকেরা নিজেদের সুবিধার্থে যা বোঝায় তাই বোঝে। কারণ অধিকাংশ লোক কোরান বা অন্য ধর্ম শাস্ত্র পাঠ করলেও তা যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে করে না, মোহ মুক্ত হয়ে করে না। আর এক ধরণের মানুষ আছে যারা ধর্মমোহের বিশ্বাসের ভাইরাসে আচ্ছন্ন, তার যুক্তিহীন বিশ্বাসের তাড়নায় আবেগতাড়িত হয়। তাদের যুক্তি প্রমাণ দিলে কোন কাজ হয় না। তবে একদম কিছু হয় না তা বলা যাবে না। বিশ্বে এখন সংশয়বাদী ও নাস্তিকের সংখ্যা ১৬% শতাংশে পৌঁছে গেছে। শুধু বাজে কথা নয় যুক্তি দিয়েই অবতারণা করতে হবে। ধর্মমোহ অন্ধবিশ্বাসের প্রাচীর ভাঙতে হবে তবেই এ বিশ্ব মানুষের বসবাসের উপযোগী হবে। নয় পাকিস্তান আফগানিস্তান হবে ...। আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়, কিন্তু তা লেখাকে দীর্ঘায়িত করবে, পড়ার ইচ্ছা চলে যাবে। তাই বলি কোরান গীতা বেদ যাই পড়ুন  যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে পড়ুন। সুরা ও   আয়াতগুলি যুক্তির দ্বারা বিশ্লেষণ করুন।

(তথ্য : কোরান, সহি বুখারী, আলী দোস্তির  মুহাম্মদের তেইশ বছর।)

সংগঠিত ধর্ম কোনোদিন ডারউইনকে পছন্দ করেনি -
শম্ভুনাথ চার্বাক
Nov. 26, 2024 | যুক্তিবাদ | views:881 | likes:2 | share: 2 | comments:0

প্রথম দিনের সূর্য প্রশ্ন করেছিল সত্তার নূতন আবির্ভাবে – কে তুমি, মেলেনি উত্তর দিবসের শেষ সূর্য শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল পশ্চিম সাগরতীরে, 

নিস্তব্ধ সন্ধ্যায় –কে তুমি, পেল না উত্তর। 

      (  শেষ লেখা -রবীন্দ্রনাথ ) 

জীব সৃষ্টি  হয়েছে কিভাবে? জীবকে সৃষ্টি  করেছে কে? এই প্রশ্ন মানুষের মনে নিরন্তর ঝড় তুলেছে সভ্যতার বিকাশের শুরুর সময়  থেকেই  বড় বড় বিশ্বমানবরাও দ্বিধাগ্রস্ত এই ব্যাপারে। ছোটবেলা থেকেই উঠতে বসতে ঘরে বাইরে শুনে আসছি সব তার সৃষ্টি। প্রশ্ন এসেছে মনে, জিজ্ঞাসা করলেই বলতো ডেঁপো ছেলে। প্রমাণের কি আছে হাজার-হাজার বছর ধরে মানুষ এবং তোমার পূর্ব পুরুষেরা বিশ্বাস করে আসছে, তোমাকেও তাই বিশ্বাস করতে হবে বিনা প্রশ্নেই। এসব বলেই দাবিয়ে দেওয়া হয়েছে, বেশী বললেই মার জুটতো কপালে। ধর্মের বিবর্তনের এবং ঈশ্বর-গড-আল্লাহদেরও বিবর্তন ঘটেছে এই পৃথিবীতে।  ব্যাবিলন সুমের মিশর আরব  নরওয়ে রোম গ্রীসের পেগান বা মূর্তিপূজকদের  দেবদেবীদের  ইহুদী খ্রিস্টান ও ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা  বিলুপ্ত করে দিয়েছে পৃথিবী থেকে। একমাত্র ভারতে উদ্ভুত পেগান বা মূর্তীপূজক ধর্মগুলি টিকে আছে। তাও আজও সারা পৃথিবীতে প্রায় ৪২০০ ধর্ম টিকে আছে। এই  প্রচলিত বৃহৎ  প্রাতিষ্ঠানিক  ধর্ম হিন্দু খ্রিস্টান ইসলাম ইহুদী সবাই  বলে তাদের নিজেদের  ঈশ্বর-গড-আল্লাহই সর্বশ্রেষ্ঠ। ঈশ্বরদের কোন সার্বজনিনতা নেই। সব ধর্মের প্রধান পুরুষ, কোন মহিলা নেই। এদের ঈশ্বর – গড – আল্লাহ  প্রত্যেকেই একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী এবং প্রত্যেকটি ধর্ম অপর ধর্মের ওপর আঘাত হেনেই বিকাশ লাভ করেছে এবং বারবার ধর্মের কারণে পৃথিবীকে রক্তাক্ত করেছে। ভারতে  হিন্দু বনাম বৌদ্ধ বা জৈনের লড়াই, শৈব শাক্ত বৈষ্ণবের লড়াই বাংলা দেখেছে  মধ্যযুগে এবং হিন্দু মুসলিম খ্রিস্টানের লড়াইও দেখেছে, দেশভাগ দেখেছে ধর্মের কারণে, উদ্বাস্তু হওয়া দেখেছে ধর্মের কারণে।  রক্তাক্ত ক্রুসেড দেখেছে এশিয়ার ভূখন্ড ।

               চার্লস ডারউইন ইংল্যান্ডের অভিজাত পরিবারের সন্তান ছিলেন। নিজেও প্রচণ্ড ধর্মভীরু ছিলেন এবং ভবিষ্যতে ধর্মযাজক হওয়ার স্বপ্নও দেখতেন । কারণ ইংল্যান্ডে সেই সময় ধর্মজাজক হওয়া যথেষ্ট সম্মানের । কিন্তু জীব বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করার সময় জীব ও জীব সৃষ্টির জিজ্ঞাসা ডারউইনের কিশোর মনে ঝড় তুলেছিল প্রচন্ডভাবে। সেই ঝড়েই ডারউইনের জাহাজ বিগল গ্যালাপাগাস দ্বীপে অবতরণ করলো ১৮৩৫ সালের ২০ শে ফেব্রুয়ারী। আগামী  ১২ই  ফেব্রুয়ারী ডারউইনের জন্মদ্দিন।  ডারউইনের চিন্তা ভাবনাকে যেন উসকে দিতেই এইদিন চিলির উপকূলে নোঙর করা অবস্থায় তাঁদের জাহাজ এইচ এম এস বিগল কেঁপে উঠলো প্রবল এক-ভূমিকম্পে! দুই মিনিটের সেই ভূমিকম্প শেষে ডারউইন এবং জাহাজের ক্যাপ্টেন মহাবিস্ময় নিয়ে আবিষ্কার করলেন উপকূলের ভূমির উচ্চতা বেড়ে গেছে প্রায় আট ফুট! তাহলে কি লায়েলের Principle of Geology’র কথাই ঠিক? সব পরিবর্তনই কি প্রকৃতির খামখেয়ালিপনা করা শক্তিগুলোর ফলাফল?

১৮৩১ সালে জাহাজে ওঠার আগে ডারউইনকে তাঁর শিক্ষক এবং একইসাথে প্রখ্যাত বিজ্ঞানী প্রফেসর হেনেস্লো অপর এক প্রখ্যাত ভূতাত্ত্বিক চার্লস লায়েলের লেখা Principle of Geology বইটি উপহার দেন। গভীরভাবে ঈশ্বরে বিশ্বাসী হেনেস্লো কড়াভাবে ডারউইনকে বলে দেন যেন ভুলেও লায়েলের লেখাগুলোকে বিশ্বাস না করেন! কিন্তু ডারউইন জাহাজে যেতে যেতে প্রকৃতির খামখেয়ালীপনা দেখতে দেখতে গুরুর উপদেশ ভুলে গভীর সন্দেহে নিজেকে প্রশ্ন করতে শুরু করেন একের পর এক। কি ছিল লায়েলের সেই বইয়ে! লায়েল তাঁর বইয়ে বলেছিলেন, “নূহের আমলের এক কথিত মহাপ্লাবন দিয়ে পৃথিবীর ভূ-ভাগ রূপান্তরিত হয়নি। ভূভাগ বিবর্তনের অন্যতম কারণ হল বাতাস, বৃষ্টি, ভূমিকম্পের মতন অসংখ্য ছোটবড় প্রাকৃতিক শক্তি। এগুলোই অতীত থেকে বর্তমান সময়ে ভূভাগের পরিবর্তন ঘটিয়ে এসেছে এবং আসছে।” গুরুর কথা ভুলে ডারউইন তাই মনোনিবেশ করলেন আশেপাশের ভূপ্রকৃতির উপর এবং আস্তে আস্তে দীক্ষিত হয়ে উঠলেন লায়েলের সেই যুক্তিপূর্ণ রূপান্তরের মতবাদে। আর তার চাক্ষুষ প্রমাণ আজ পেলেন।

এই ভূমিকম্প নিয়ে ভাবতে ভাবতেই যাত্রাপথে আবার জাহাজে করে ঘুরতে ঘুরতে এসে পড়লেন ভার্ডে দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪৫ ফুট উঁচু একটি দ্বীপে। সেখানে দেখা গেল পাহাড়ের গায়ে এক রহস্যময় সাদা দাগ চলে গেছে মাইলের পর মাইল। পরীক্ষা করে জানা গেল রহস্যের তেমন কিছুই নেই, শামুক ঝিনুকের খোলের চুনাপাথরের ক্ষয়ই এই লম্বা দাগের রহস্য। কিন্তু শামুক ঝিনুক এতো উঁচুতে এক পাহাড়ের গায়ে এলো কিভাবে? তাহলে কি একসময় সেই পাহাড় লুকিয়ে ছিল সমুদ্রের জলের নিচে?

আর সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপারটি দেখা গেল গ্যালাপ্যাগাস দ্বীপপুঞ্জে নামার পর। এই দ্বীপপুঞ্জের বিভিন্ন দ্বীপ দেখতে দেখতে তরুণ ডারউইন দেখতে পেলেন বিভিন্ন প্রজাতির একগাদা ফিঞ্চ পাখি, যেগুলোকে আমরা ফিঙে নামে ডাকি। ডারউইন অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন সবগুলোই ফিঞ্চ পাখি হলেও অবাক করা জিনিস হলো এদের খাবারের প্রকৃতি অনুযায়ী বদলে গেছে এদের গঠন। যেমন যেগুলো গাছে থাকে তারা খায় একরকম খাবার, যেগুলো মাটিতে থাকে তারা খায় আরেকরকমের খাবার। খাবারের ধরন অনুযায়ী সেই পাখিগুলোর আকৃতিও বিশেষ করে চঞ্চু আলাদা! তিনি এই বৈচিত্র্য দেখতে দেখতেই এদের ১৩টি প্রজাতির বর্ণনা দেন, দেখান প্রজাতির বৈচিত্র্য। এই ১৩টির পর বর্তমানে আর একটিসহ মোট ১৪টি প্রজাতির ফিঞ্চ আমরা প্রকৃতিতে দেখতে পাই। এই পাখিদের দেখার পরেই তিনি প্রাথমিকভাবে সম্মত হলেন যে, বেঁচে থাকার প্রয়োজনেই জীবের মাঝে একেকরকম বৈশিষ্টের পরিবর্তন ঘটে এবং তারা ক্রমেই অভিযোজিত হয়ে তৈরি করে এক বা একাধিক নতুন প্রজাতি! সুতরাং প্রজাতি হল এমন কিছু জীবের সমষ্টি যারা শুধু নিজেদের মধ্যে প্রজননে সক্ষম। যেমন- আধুনিক মানুষ Homo sapiens sapiens প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত। অন্য কোন প্রজাতির সঙ্গে তারা কেউ প্রজনন করতে পারবে না!

ডারউইন আদতে এই তথ্যটি প্রকাশ করতে যথেষ্ট দ্বিধা করেছেন। কেননা তিনি নিজেও বুঝেছিলেন তাঁর দেওয়া মতবাদ কতটা বৈপ্লবিক। আরেক বিজ্ঞানী হুকারের কাছে লেখা চিঠিতে তাই তিনি লিখেছিলেন - নিজেকে তাঁর বড় একজন অপরাধী মনে হচ্ছে, তিনি যেন একজন নরঘাতক হিসেবে স্বীকারোক্তি দিচ্ছেন! তাই তত্ত্বের সত্যতা জেনেও কেবলমাত্র সন্দেহাতীতভাবে নিশ্চিত হতে তিনি আরও ২০ বছর ধরে গবেষণা করে লিখলেন জীববিজ্ঞানের ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত বই- The origin and Species by means of Natural Selection!!

ডারউইনের তত্ত্ব যে ভুল নয় তার প্রমান আমরা দেখতে পাই অন্যপ্রাণীদের মতন মানুষেরও অসংখ্য প্রজাতি আবিষ্কৃত হওয়ায়। এগুলোর মধ্যে হোমিনিড গণের অন্তর্ভুক্ত হোমো স্যাপিয়েন্স, হোমো ইরেক্টাস-সহ অসংখ্য প্রজাতির ফসিল আবিষ্কৃত হয়েছে। আবিষ্কৃত হয়েছে মানুষের মতন আরও অন্য এক প্রজাতি নিয়ান্ডারথালদের ফসিল। অনেক গবেষণার পর দেখা গেছে একপ্রজাতির বনমানুষ বা এপদের সঙ্গে মিলে গেছে আমাদের ডিএনের প্রায় ৯৮.৬%! ডারউইনের সময় কার্বন ডেটিং-সহ অনেক পরীক্ষার সুব্যবস্থা না থাকলেও এটা এখন পরীক্ষিত গবেষণাধর্মী সত্য যে, ৪০-৮০ লক্ষ বছর আগে একধরণের জাতি দুইপায়ে ভর করে দাঁড়াতে শিখলেও তাদের থেকে বর্তমান আমাদের অর্থাৎ আধুনিক মানুষের উদ্ভব ঘটেছে মাত্র দেড় থেকে দুইলক্ষ বছর আগে। এপর্যন্ত একটি ফসিলও পাওয়া যায়নি যেটি ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন মতবাদকে সমর্থন করেনা। এমনকি মজার কথা হল ডারউইন পূর্ববর্তী সময়েও জর্জ বুফো, হাওয়ার, ওয়ালেস, উইঙ্গারসহ বেশকিছু বিজ্ঞানী ছিলেন যারা বুঝতে পেরেছিলেন প্রজাতি স্থির নয়, চলমান বিবর্তনের ফসল। কিন্তু এরা বিবর্তনকে মেনে নিলেও সেটি কিভাবে ঘটে তা কেউই ডারউইনের আগে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেননি। বিখ্যাত বিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্সের বহুল পঠিত Ancestor’s Tale বা আশির দশকে ড. টিএম বেড়ার লেখা Evolution and Myth of Creationism কোনোটিই ডারউইনের বিবর্তনবাদ অতিক্রম করেনি, বরং সমর্থন যুগিয়েছে বহুগুনে। ডকিন্স তাঁর প্রতিটি লেখায় তুলে এনেছেন বিবর্তনবাদের মৌলিকত্বকে। তিনি বারবার বলেছেন- এখন পর্যন্ত একটি ফসিলও ভুল জায়গায় আবিষ্কৃত হয়নি যেটি বিবর্তনবাদকে ভুল প্রমাণ করতে পারে!

বিজ্ঞান গতিশীল, যে গতিশীলতা প্রজাতিগুলোর পারস্পারিক সম্পর্ক নির্দেশ করে। হাজার বছরের বিশ্বাসকে লালন করার নাম বিজ্ঞান নয়, বিশ্বাসকে যুক্তিপূর্ণভাবে ব্যবচ্ছেদ করা এবং তার সত্যতা বা মিথ্যাচারকে সত্যের আলোকে উন্মোচন করাই বিজ্ঞানের কাজ।ডারউইনবাদ আর বিবর্তন এতটাই প্রমাণিত যে সেটি ঘটেছে কি ঘটেনি তা নিয়ে সন্দেহের কোনোই অবকাশ নেই। 

হাজার হাজার বছর ধরে ঈশ্বর আশ্রিত ভাবনা ঝেড়ে ফেলতে পারেননি  ডারউইন, বিজ্ঞান নিয়ে চর্চা না করলে হয়তো যাজকই হতেন বা ধর্ম তত্ত্বের অধ্যাপক হতেন, আবার মন থেকে জীব সৃষ্টির  সেই ঈশ্বরের তত্ত্ব মেনে নিতেও পারেননি ডারউইন। হাজার হাজার বছর ধরে যে ধর্ম ঘিরে রয়েছে পৃথিবীকে (থুড়ি পৃথিবী বললে ভুল হবে এশিয়া-আরব-ইউরোপকে। কারণ আমেরিকা ওসেনিয়া মহাদেশের কথা কোনো প্রাতিষ্ঠানিক  ধর্মগ্রন্থতে ছিলোনা। ১৫২৬ সালের আগে আমেরিকায় সভ্য মানুষের পদার্পন ঘটেনি। শেষ সংগঠিত ধর্ম ইসলামের জন্ম ৬০০ সাল নাগাদ। ডারউইন ধর্মের আলোকে জীবের সৃষ্টির  উত্তর পাওয়ার জন্য বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ পাঠ করলেন, কিন্তু অশান্ত মনকে শান্ত করতে পারলেন না। পরবর্তী সময়ে বিখ্যাত ইংরেজ দার্শনিক জন লকের বিখ্যাত উক্তি “বস্তু থেকে চেতনার উদ্ভব” আবার তাঁকে অশান্ত করে তুললো। সুযোগ পেলেন জীব বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করার, চাপলেন বিগল নামের জাহাজে গ্যালাপাগাস দ্বীপে যাওয়ার জন্য। গ্যালাপাগাস দ্বীপে তিনি বিভিন্ন জীবজন্তুর সন্ধান পেলেন এবং হাজার  হাজার জীবাশ্মের সন্ধান পেলেন, প্রায় ২৫০০০ জীবাশ্ম পাঠিয়ে দিলেন ইংল্যান্ডে। দীর্ঘদিন সেগুলি পরীক্ষা করে সিদ্ধান্তে এলেন জড় পদার্থ থেকেই জীবের উৎপত্তি এবং তার ক্রমবিকাশের শেষ পর্যায়ে  মানুষের উৎপত্তি। তিনি লিখলেন  “the origin of species by means of natural selection,of the preservation of favoured  races in the struggle for life”। এই বইটা বেরোনোর সাথে সাথে সংগঠিত ধর্মের বিকৃত মানুষেরা প্রতিক্রিয়া দিতে শুরু করলো। কোপারনিকাস, গ্যালিলিও, জিওনার্দো ব্রুনোর পর  ডারউইনের এই আঘাতে প্রবল  প্রতিক্রিয়া প্রত্যাশিতই  ছিল। ইংল্যান্ডের ধর্মান্ধ ব্যক্তিরা তাঁকে নানানভাবে অপদস্থ করা থেকে  প্রাণে মারতেও  চাইলেন । শুধু প্রাণে মারতে পারেনি কারণ ডারউইনের সমর্থনে ঈংল্যান্ডের কিছু বিখ্যাত অভিজাত পরিবারের মানুষ দাড়িয়েছিলেন। (আমাদের দেশের বিখ্যাত চিকিৎসক সুশ্রুতের শল্য চিকিৎসা যখন  ব্রাহ্মণদের নেতা যাজ্ঞবল্ক বন্ধ করে দিলেন তখন কিন্তু তিনি  কারো সমর্থন পাননি, নয়তো ভারত আজ  চিকিৎসা শাস্ত্রে অনেক দূর এগিয়ে যেতো)  এদের মধ্যে  বিশেষ করে উল্লেখ করতে হয় টমাস হাক্সলি, শল্য চিকিৎসক ডাঃ ওয়েনের কথা। টমাস হাক্সলিকে ডারউইনের ডালকুত্তা নামেও  অভিহিত করা হয়।

দর্শনের যে মূল সঙ্ঘাত সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন ডারউইন। ধর্মে জীব সৃষ্টিতে ঈশ্বর আছেন। কিন্তু ডারউইনের বইতে সৃষ্টিকর্তা হিসাবে ঈশ্বর  নেই আছে “প্রকৃতি ও পরিবেশ”। ঈশ্বরের ঠাঁই নেই সেখানে। সেসময়  ডারউইনকে কি পরিমাণ আক্রমণ  হজম করতে হয়েছিল নীলকন্ঠ হয়ে তা এখন  ভাবা যায় না। এই ধর্মান্ধ কীটেরা কি ভয়ানক তা আজ ভারত পাকিস্তান বাঙলাদেশের আমাদের মত উদ্বাস্তুরা  ও মুক্তমনারা জানে,  জানে অভিজিত রায় রাজিব ওয়াশিকর নাজিমুদ্দিন নিলয় বা আমাদের দেশের দাভালকার-পানেসর-কালবুর্গী-খলিল-গৌরি লঙ্কেশ। সারা আরবের সিরিয়া,জর্ডন, ইরাক, তুরস্কের উদবাস্তুরা জানে, পাকিস্তান, আফগানিস্তানের উদ্বাস্তুরা জানে । 

এই সব উদ্বাস্তুদের  তথাকথিত কোন ঈশ্বর –আল্লাহ-গডেরা রক্ষা করেনা। আমেরিকাতে ডারউইনের বিবর্তনবাদ পড়ানোর জন্য শিক্ষকের শাস্তি হয়েছিল, যা মাঙ্কি ট্রায়াল নামে সারা পৃথিবীতে  খ্যাত। 

আমার মনে হয় পৃথিবীতে অনেক প্রখ্যাত পদার্থ বা রসায়ন  বৈজ্ঞানিক অনেক গুরুত্বপূর্ণ  কাজ করেছেন, সভ্যতাকে এগিয়ে দিয়েছেন অনেকদূর।কিন্তু বিজ্ঞানের কাজের প্রভাব বিজ্ঞান ছাড়িয়ে সমাজ, ধর্ম, শিল্প, সংস্কৃতি ও রাজনীতির জগতকে সব থেকে আলোড়িত করেছিল চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদ।ডারউইনের উপর সারা পৃথিবী জুড়ে সংগঠিত ধর্মের   একের পর এক আক্রমনই এর সব থেকে বড় প্রমাণ। একারণেই সংগঠিত ধর্ম কোনোদিনই ডারউইনকে পছন্দ করেনি বরং বিরোধীতা করে।

         সম্প্রতি  বাংলাদেশের ইসলামিক ধর্মগুরুরা বলেছেন বিজ্ঞান  পড়ান, কিন্তু বিবর্তন পড়ানো চলবেনা।  ওরা জানে বিবর্তন পড়ালে অন্য  ধর্মের সাথে ইসলামের আল্লাহ নিয়েও প্রশ্ন  উঠবে। আর কোরানেইতো বিবর্তন এর প্রমাণ আছে। আল্লাহর সৃষ্ট  প্রথম মানব আদম 60 হাত থেকে বর্তমানের   সর্বোচ্চ আট ফুট হয়ে যায়। এটাই তো বিবর্তন।  এটা মাদ্রাসার  হুজুরদের  বোঝানো যাবেনা।

ব্রাহ্মণদের শাস্ত্রভিত্তিক চৌর্যবৃত্তি কবে বন্ধ হবে? -
শম্ভুনাথ চার্বাক
Nov. 25, 2024 | ধর্ম | views:281 | likes:2 | share: 2 | comments:0

বিখ্যাত সাহিত্যিক শিবরাম চক্রবর্তীর মস্কো থেকে পন্ডিচেরির ব্রাহ্মণদের সম্পর্কে লেখা দিয়েই শুরু করি -

আমাদের সনাতন ব্রাহ্মণেরা ব্রহ্মচিন্তার সঙ্গে অর্থচিন্তার কী অপূর্ব সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন --- একাধারে যেমন বেদ উপনিষদ, গীতা  যা মান্যতা  দেয়   শূদ্র ও নারীদের দাবিয়ে রাখার জটিল তত্ত্ব  আর অন্যধারে  অন্যদিকে সমাজের বৃহত্তর শূদ্র শ্রেণীর মানুষকে দাবিয়ে রাখার   প্রত্যক্ষ ধর্মের গ্রন্থ মনুসংহিতা। এই দাবিয়ে রাখতে গিয়েই বিভিন্ন জটিল ধর্মীয় আচার  ও  সংস্কৃতির মাধ্যমেই ব্রাহ্মণদের  আয়ের ব্যবস্থা বা এক কথায় বলা যায় শাস্ত্রানুসারী চৌর্য্যবৃত্তি। ব্যক্তি নির্বিশেষে  জন্মের আগেই সাধ থেকে শুরু করে ছয় ষষ্টী, অন্নপ্রাশন,  বিয়ে, বেচারার শ্রাদ্ধ পর্যন্ত ট্যাক্সো আদায়, এমন কি, বহুকাল আগে খতম হয়ে গেলেও তার পুত্রপৌত্রাদিক্রমে নেড়া মাথার ওপর বংশানুক্রমে বাৎসরিকের মাধ্যমেই জিজিয়া এবং এছাড়াও  বারো মাসে তেরো পার্বন  গৃহ প্রবেশ দোকান শুরুর পুজোতো আছেই।  দুর্গ্রহক্রমে এই ভূগ্রহে জন্মাবার ও মরবার পাপের শাস্ত্রমত প্রায়শ্চিত্ত আমাদের ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের  মূলধন বিহীন চিরকেলে ব্যবসা,  একদম বিনা পুঁজির ফলাও কারবার।  অর্থনীতিতে  সেই সময়ে নোবেল পুরস্কার থাকলে আমাদের দেশের ব্রাহ্মণদের অনেকেই এই পুরস্কার পেতেন।  ইংল্যান্ডের স্টুয়ার্ট মিল; অ্যাডাম স্মিথ  বা লর্ড কেইনসও ভাবতে পারেননি এই রকম হরেক  ট্যাক্সের কথা  


 কয়েক দিন  আগে এক ছাত্রের মায়ের শ্রাদ্ধে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম। শ্রাদ্ধবাড়িতে যাই না এবং যাওয়া  ভীষণভাবে অপছন্দ করি। নিজের মা – বাবার মৃত্যুর পর শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করিনি, সাদা কাপড় পরিধান করিনি, চুল কাটিনি, এক এক কথায় কিছুই করিনি, এই জন্য পাড়ায় আমার বেশ  বদনাম আছে  নাস্তিক হিসেবে। যে মানুষের মৃত্যুর আগে তাকে বিন্দুমাত্র সাহায্য করতে পারিনি তার শ্রাদ্ধে কবজি ডুবিয়ে খেয়ে এসে সেটা সম্পর্কে গল্প করতে খারাপ লাগে তাই ছাত্রদের  বলে দিয়েছিলাম যেতে পারি কিন্তু কিছু মুখে দেবো না। কিছু কিছু জায়গায় যেতেই হয় তাদের মান এবং মন রক্ষার্থে। যে বাড়িতে গিয়েছিলাম তারা তিন ভাইই আমার পূর্বতন ছাত্র এবং প্রায়ই  বাড়ির দোরগোড়ায় থাকে ফলে যেতে একপ্রকার বাধ্যই হয়েছিলাম। তাদের বাবা নেই, মা দীর্ঘদিন ধরে বিছানায় ছিলেন। ভাইয়েরা মিলে রান্না করে মায়ের শুশ্রূষা করেছে  বছর তিনেক ধরে। কাজকর্মও সেভাবে কিছু করে না, বড়জন সম্পূর্ণ বেকার, মেজোর একটা অটো আছে লিজে দেওয়া, শুধুমাত্র ছোটটি একটা প্রাইভেট ফার্মে কাজ করে। মাঝে মধ্যে  দু একবার দেখতে যাওয়া ও মা কেমন আছে জিজ্ঞাসা করা ও আহা উহু করা ছাড়া আর কিছু সাহায্য তাদের করিনি। অথচ শ্রাদ্ধের নিয়মভঙ্গের দিন সবাইকে নেমন্তন্ন করেছে। আমার বাড়ির লোক শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে যাওয়া পছন্দ করে না । তারা কেউ যাবে না অগত্যা আমাকেই শ্রাদ্ধের দিন ফুল মালা ধূপকাঠি  হাতে  দেখা  করতে যেতে  হল। শ্রাদ্ধের দিন পুরোহিত মহাশয় দুজন দিয়ে শ্রাদ্ধ করানো হয়েছে। সেদিনও দুশো লোক খেয়েছে এবং নিয়মভঙ্গের দিন প্রায় পাঁচশো লোক নিমন্ত্রিত। তাকে শ্রাদ্ধের আগে ঠারেঠুরে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছি শ্রাদ্ধ ব্যাপারটির কোনো যৌক্তিকতা নেই, মরার পর মানুষের স্মৃতি আর কাজ ছাড়া কিছুই থাকে না। তোরা মায়ের জন্য যা যা করেছিস এই কবছরে তার থেকে বেশী পুণ্য আর কিছু নেই, এই শ্রাদ্ধানুষ্ঠান  ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের অপরের মাথায় টাক দিয়ে খাওয়ার ব্যবস্থা। কে কবে দেখেছে মৃত ব্যক্তি খেতে আসে? আদিম অজ্ঞ মানুষের ভয় ও বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে পুরোহিতেরা নিজেদের আয়ের ব্যবস্থা করেছে। এগুলি ধর্ম নয় এগুলি অধর্ম,  ব্রাহ্মণদের প্রবর্তিত হিন্দুদের কু-আচার।   পুনর্জন্ম  বা পরলোক বলে কিছু নেই,  মানুষ  প্রকৃতি পরিবেশের  সৃষ্টি ও মৃত্যুর পর সব প্রকৃতিতে বিলীন হয়ে যায়। পুরোহিত শ্রেণি মানুষকে ভয় দেখিয়ে মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে ব্যবসা করে, যেমন -

১) জন্মের আগে সাধ ও  ছয়দিনে ছয় ষষ্ঠী

২) অন্নপ্রাশন

৩) বিবাহ

৪) মৃত্যু

৫) মরার পরও ছাড় নেই, তার পুত্র প্রপৌত্রদের থেকে বাৎসরিকের নামে  চাঁদা  আদায় করে।


কিন্তু আমার ছাত্ররা এতো কুসংস্কারগ্রস্থ পরিবারে মানুষ হয়েছে   যে তাদের  যুক্তি দিয়ে বোঝানো খুব কঠিন। যাইহোক  আমাকে  তারা পাড়ার  লজে নিয়ে গেল। সেখানে  গিয়ে দেখি রুই মাছ এবং বিশাল বিশাল পাবদা মাছ পটল চিংড়ির ব্যবস্থা ছাড়াও মিষ্টি আইসক্রিমের ব্যবস্থা আছে। আমাকে প্রায় জোর করেই খেতে বসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা  হল।  আমি  পরিষ্কার  জানালাম  পেট পুরে খেয়ে এসেছি কোনোমতেই খেতে পারবো না। তখন ওরা বসতে বলল  এবং কিছুক্ষণ থাকতে অনুরোধ  করল।   সেখানে বসে কয়েকজন প্রাক্তন  ছাত্রের সাথে আলোচনা করছিলাম  রামায়ণের দশরথের পুরোহিত জাবালির কথা।  সেই যুগের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান এর বিরুদ্ধে জাবালি প্রতিবাদ  করেছিল।  বুঝলাম আমাদের সমাজের  শিক্ষার  পদ্ধতির পরিবর্তন  না হলে এই ব্যবস্থা চলতে থাকবে। এই মৃত্যুভোজ  কবে বন্ধ হবে জানিনা?

এইসব  অনুষ্ঠানগুলি কবে যে মানুষ বাদ দেবে জানি না। ঐ ছেলে তিনটির তেমন আয় নেই।  বাবার জমানো যা পুঁজি ছিল তা বোধ হয় মায়ের শ্রাদ্ধে শেষ করেছে। এরপর কি হবে? এইসব ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের পেট ভরার অনুষ্ঠান মানুষকে ধনেপ্রাণে শেষ করে। বর্তমান দিনের অল্প কিছু আধুনিক সৎ ব্রাহ্মণ পদবিধারীদের এই অনুষ্ঠানকে ঘৃণা করে দেখেছি। নিজেরা এই অনুষ্ঠান থেকে দূরে থাকে।


আমরা যারা নিজেদের শিক্ষিত যুক্তিবাদী মনে করি তারাতো এই অনুষ্ঠানগুলি বর্জন করতে পারি নিজেদের জীবন থেকে! সমস্ত পারিবারিক অনুষ্ঠান থেকে ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের বিসর্জন দিতে পারি। জন্ম মানুষের জীবনে এক দুর্ঘটনার মতো, ৩০ - ৩৫ কোটি শুক্রানু লড়াই করে একটা বাঁচে, সেটাই মানুষ হয়, কিন্তু মৃত্যু অনিবার্য। জন্ম যেমন প্রকৃতি উদ্ভুত তেমন মরার পর সে পোড়াও বা কবরে দাও সবই প্রকৃতিতে ফিরে যায়। তখন স্মৃতি ছাড়া আর কিছুই থাকেনা, যাকে অনেকে আত্মা বলে। আর শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান না করে শ্রদ্ধানুষ্ঠান স্মরণসভা করতে পারি! এতে মৃতের প্রতি সঠিক শ্রদ্ধা জানানো হয় আবার ব্রাহ্মণদের শাস্ত্রানুযায়ী চৌর্যবৃত্তিকে প্রতিরোধ করাও যায়।

ব্রাহ্মণদের শাস্ত্রভিত্তিক চৌর্যবৃত্তি কবে বন্ধ হবে? -
শম্ভুনাথ চার্বাক
Nov. 25, 2024 | ধর্ম | views:902 | likes:2 | share: 2 | comments:0

বিখ্যাত সাহিত্যিক শিবরাম চক্রবর্তীর মস্কো থেকে পন্ডিচেরির ব্রাহ্মণদের সম্পর্কে লেখা দিয়েই শুরু করি -

আমাদের সনাতন ব্রাহ্মণেরা ব্রহ্মচিন্তার সঙ্গে অর্থচিন্তার কী অপূর্ব সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন --- একাধারে যেমন বেদ উপনিষদ, গীতা  যা মান্যতা  দেয়   শূদ্র ও নারীদের দাবিয়ে রাখার জটিল তত্ত্ব  আর অন্যধারে  অন্যদিকে সমাজের বৃহত্তর শূদ্র শ্রেণীর মানুষকে দাবিয়ে রাখার   প্রত্যক্ষ ধর্মের গ্রন্থ মনুসংহিতা। এই দাবিয়ে রাখতে গিয়েই বিভিন্ন জটিল ধর্মীয় আচার  ও  সংস্কৃতির মাধ্যমেই ব্রাহ্মণদের  আয়ের ব্যবস্থা বা এক কথায় বলা যায় শাস্ত্রানুসারী চৌর্য্যবৃত্তি। ব্যক্তি নির্বিশেষে  জন্মের আগেই সাধ থেকে শুরু করে ছয় ষষ্টী, অন্নপ্রাশন,  বিয়ে, বেচারার শ্রাদ্ধ পর্যন্ত ট্যাক্সো আদায়, এমন কি, বহুকাল আগে খতম হয়ে গেলেও তার পুত্রপৌত্রাদিক্রমে নেড়া মাথার ওপর বংশানুক্রমে বাৎসরিকের মাধ্যমেই জিজিয়া এবং এছাড়াও  বারো মাসে তেরো পার্বন  গৃহ প্রবেশ দোকান শুরুর পুজোতো আছেই।  দুর্গ্রহক্রমে এই ভূগ্রহে জন্মাবার ও মরবার পাপের শাস্ত্রমত প্রায়শ্চিত্ত আমাদের ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের  মূলধন বিহীন চিরকেলে ব্যবসা,  একদম বিনা পুঁজির ফলাও কারবার।  অর্থনীতিতে  সেই সময়ে নোবেল পুরস্কার থাকলে আমাদের দেশের ব্রাহ্মণদের অনেকেই এই পুরস্কার পেতেন।  ইংল্যান্ডের স্টুয়ার্ট মিল; অ্যাডাম স্মিথ  বা লর্ড কেইনসও ভাবতে পারেননি এই রকম হরেক  ট্যাক্সের কথা  


 কয়েক দিন  আগে এক ছাত্রের মায়ের শ্রাদ্ধে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম। শ্রাদ্ধবাড়িতে যাই না এবং যাওয়া  ভীষণভাবে অপছন্দ করি। নিজের মা – বাবার মৃত্যুর পর শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করিনি, সাদা কাপড় পরিধান করিনি, চুল কাটিনি, এক এক কথায় কিছুই করিনি, এই জন্য পাড়ায় আমার বেশ  বদনাম আছে  নাস্তিক হিসেবে। যে মানুষের মৃত্যুর আগে তাকে বিন্দুমাত্র সাহায্য করতে পারিনি তার শ্রাদ্ধে কবজি ডুবিয়ে খেয়ে এসে সেটা সম্পর্কে গল্প করতে খারাপ লাগে তাই ছাত্রদের  বলে দিয়েছিলাম যেতে পারি কিন্তু কিছু মুখে দেবো না। কিছু কিছু জায়গায় যেতেই হয় তাদের মান এবং মন রক্ষার্থে। যে বাড়িতে গিয়েছিলাম তারা তিন ভাইই আমার পূর্বতন ছাত্র এবং প্রায়ই  বাড়ির দোরগোড়ায় থাকে ফলে যেতে একপ্রকার বাধ্যই হয়েছিলাম। তাদের বাবা নেই, মা দীর্ঘদিন ধরে বিছানায় ছিলেন। ভাইয়েরা মিলে রান্না করে মায়ের শুশ্রূষা করেছে  বছর তিনেক ধরে। কাজকর্মও সেভাবে কিছু করে না, বড়জন সম্পূর্ণ বেকার, মেজোর একটা অটো আছে লিজে দেওয়া, শুধুমাত্র ছোটটি একটা প্রাইভেট ফার্মে কাজ করে। মাঝে মধ্যে  দু একবার দেখতে যাওয়া ও মা কেমন আছে জিজ্ঞাসা করা ও আহা উহু করা ছাড়া আর কিছু সাহায্য তাদের করিনি। অথচ শ্রাদ্ধের নিয়মভঙ্গের দিন সবাইকে নেমন্তন্ন করেছে। আমার বাড়ির লোক শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে যাওয়া পছন্দ করে না । তারা কেউ যাবে না অগত্যা আমাকেই শ্রাদ্ধের দিন ফুল মালা ধূপকাঠি  হাতে  দেখা  করতে যেতে  হল। শ্রাদ্ধের দিন পুরোহিত মহাশয় দুজন দিয়ে শ্রাদ্ধ করানো হয়েছে। সেদিনও দুশো লোক খেয়েছে এবং নিয়মভঙ্গের দিন প্রায় পাঁচশো লোক নিমন্ত্রিত। তাকে শ্রাদ্ধের আগে ঠারেঠুরে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছি শ্রাদ্ধ ব্যাপারটির কোনো যৌক্তিকতা নেই, মরার পর মানুষের স্মৃতি আর কাজ ছাড়া কিছুই থাকে না। তোরা মায়ের জন্য যা যা করেছিস এই কবছরে তার থেকে বেশী পুণ্য আর কিছু নেই, এই শ্রাদ্ধানুষ্ঠান  ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের অপরের মাথায় টাক দিয়ে খাওয়ার ব্যবস্থা। কে কবে দেখেছে মৃত ব্যক্তি খেতে আসে? আদিম অজ্ঞ মানুষের ভয় ও বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে পুরোহিতেরা নিজেদের আয়ের ব্যবস্থা করেছে। এগুলি ধর্ম নয় এগুলি অধর্ম,  ব্রাহ্মণদের প্রবর্তিত হিন্দুদের কু-আচার।   পুনর্জন্ম  বা পরলোক বলে কিছু নেই,  মানুষ  প্রকৃতি পরিবেশের  সৃষ্টি ও মৃত্যুর পর সব প্রকৃতিতে বিলীন হয়ে যায়। পুরোহিত শ্রেণি মানুষকে ভয় দেখিয়ে মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে ব্যবসা করে, যেমন -

১) জন্মের আগে সাধ ও  ছয়দিনে ছয় ষষ্ঠী

২) অন্নপ্রাশন

৩) বিবাহ

৪) মৃত্যু

৫) মরার পরও ছাড় নেই, তার পুত্র প্রপৌত্রদের থেকে বাৎসরিকের নামে  চাঁদা  আদায় করে।


কিন্তু আমার ছাত্ররা এতো কুসংস্কারগ্রস্থ পরিবারে মানুষ হয়েছে   যে তাদের  যুক্তি দিয়ে বোঝানো খুব কঠিন। যাইহোক  আমাকে  তারা পাড়ার  লজে নিয়ে গেল। সেখানে  গিয়ে দেখি রুই মাছ এবং বিশাল বিশাল পাবদা মাছ পটল চিংড়ির ব্যবস্থা ছাড়াও মিষ্টি আইসক্রিমের ব্যবস্থা আছে। আমাকে প্রায় জোর করেই খেতে বসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা  হল।  আমি  পরিষ্কার  জানালাম  পেট পুরে খেয়ে এসেছি কোনোমতেই খেতে পারবো না। তখন ওরা বসতে বলল  এবং কিছুক্ষণ থাকতে অনুরোধ  করল।   সেখানে বসে কয়েকজন প্রাক্তন  ছাত্রের সাথে আলোচনা করছিলাম  রামায়ণের দশরথের পুরোহিত জাবালির কথা।  সেই যুগের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান এর বিরুদ্ধে জাবালি প্রতিবাদ  করেছিল।  বুঝলাম আমাদের সমাজের  শিক্ষার  পদ্ধতির পরিবর্তন  না হলে এই ব্যবস্থা চলতে থাকবে। এই মৃত্যুভোজ  কবে বন্ধ হবে জানিনা?

এইসব  অনুষ্ঠানগুলি কবে যে মানুষ বাদ দেবে জানি না। ঐ ছেলে তিনটির তেমন আয় নেই।  বাবার জমানো যা পুঁজি ছিল তা বোধ হয় মায়ের শ্রাদ্ধে শেষ করেছে। এরপর কি হবে? এইসব ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের পেট ভরার অনুষ্ঠান মানুষকে ধনেপ্রাণে শেষ করে। বর্তমান দিনের অল্প কিছু আধুনিক সৎ ব্রাহ্মণ পদবিধারীদের এই অনুষ্ঠানকে ঘৃণা করে দেখেছি। নিজেরা এই অনুষ্ঠান থেকে দূরে থাকে।


আমরা যারা নিজেদের শিক্ষিত যুক্তিবাদী মনে করি তারাতো এই অনুষ্ঠানগুলি বর্জন করতে পারি নিজেদের জীবন থেকে! সমস্ত পারিবারিক অনুষ্ঠান থেকে ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের বিসর্জন দিতে পারি। জন্ম মানুষের জীবনে এক দুর্ঘটনার মতো, ৩০ - ৩৫ কোটি শুক্রানু লড়াই করে একটা বাঁচে, সেটাই মানুষ হয়, কিন্তু মৃত্যু অনিবার্য। জন্ম যেমন প্রকৃতি উদ্ভুত তেমন মরার পর সে পোড়াও বা কবরে দাও সবই প্রকৃতিতে ফিরে যায়। তখন স্মৃতি ছাড়া আর কিছুই থাকেনা, যাকে অনেকে আত্মা বলে। আর শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান না করে শ্রদ্ধানুষ্ঠান স্মরণসভা করতে পারি! এতে মৃতের প্রতি সঠিক শ্রদ্ধা জানানো হয় আবার ব্রাহ্মণদের শাস্ত্রানুযায়ী চৌর্যবৃত্তিকে প্রতিরোধ করাও যায়।

বিশ্বাসে বিষ -
শম্ভুনাথ চার্বাক
Nov. 24, 2024 | যুক্তিবাদ | views:882 | likes:2 | share: 2 | comments:0

১ম - তুই ঈশ্বরে অবিশ্বাস করিস?

২য় -হ্যাঁ, অবশ্যই অবিশ্বাস করি, থাকলে সামনে আবির্ভূত হন বিশ্বাস করে নেব।

১ম - দেখ, ঈশ্বর ছাড়া এই মহাবিশ্বের কল্পনাও করা যায় না।

২য় - দেখ, একমাত্র ঈশ্বরের অস্তিত্ব ছিল আর কিছুর অস্তিত্ব ছিল না এটা কিভাবে যাচাই হবে? আমরা কিভাবে জানবো সে সময় একমাত্র ঈশ্বর অস্তিত্বশীল ছিলেন?

অথচ মহাবিশ্ব মহাকাশ কিছুই ছিল না?

হ্যাঁ এটা সত্য যে আজকের মহাবিশ্ব মহাকাশ সৌরমণ্ডল নীহারিকা তারকার সর্বদা অবস্থিতি ছিল না, মহাবিশ্ব এক্সপ্যান্ড করেছে যাকে সুপারনোভা বলছেন বিজ্ঞানীরা। এই মহাবিশ্বের সমস্ত কিছুই পরিবর্তনশীল।

১ম—দেখ, সে সব প্রমাণ না দেখাতে পারলেও বলবো ঈশ্বর ছিলেন আছেন।

২য় - ঈশ্বরের কি কাজ? কেন ঈশ্বর আছেন? তাঁর থাকাতে কার কার  কি কি  উন্নতি হয়েছে? আর না থাকাতে কার কার কি কি ক্ষতি  ঘটেছে?

১ম -  দেখ বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর। ঈশ্বর  তর্কের জিনিস নয় সম্পূর্ণ ভক্তিভরে বিশ্বাসের জিনিস।

২য়  - আচ্ছা বলতো  সারা পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ এখনও ঈশ্বরের উপর বিশ্বাস হারায়নি, আমাদের গুটি কয়েক নাস্তিকের কথা বাদ দে। তাহলে ঐ কোটি কোটি ঈশ্বর বিশ্বাসী মানুষেরা চরম দুর্দশায় ভুগছে কেনো? তাঁদের খাদ্য বস্ত্র বাসস্থান নেই, শিক্ষা স্বাস্থ্যর কথা বাদই দে। ঈশ্বর এইরকম এক চোখোমি করেন কেনো?  তাহলে কি ধরে নেব সব ঈশ্বর ধনীদের গৃহেই অবস্থান করেন। সমাজে দরিদ্র অভুক্ত বস্ত্রহীন নিরাশ্রয়  মানুষের জন্য  এই ব্রহ্মাণ্ডে কোনো ঈশ্বর নেই এই মহাবিশ্বে।

 ১ম - দেখ এত প্রশ্নের জবাব দিতে পারবো না, কিন্তু ঈশ্বর ছিলেন, আছেন আর  থাকবেন এই বিশ্বাস আমার চিরকাল অটূট থাকবে।

      দুই বন্ধুর কথপোকথনে একটা জিনিষ উঠে আসে সেটা হল বিশ্বাস শুধু বিশ্বাস। এই বিশ্বাসের ভাইরাস আমাদের সমাজকে  হাজার   হাজার  বছর  ধরে কুঁড়ে  কুঁড়ে  খাচ্ছে। একটু অন্যরকম কথা শুনলেই এদের অনুভূতিতে আঘাত লাগে এবং সমস্ত রকম অসভ্যতা নিয়ে দাঁত নখ বার করে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঐ যুক্তিবাদীদের উপর। তখন সামান্য ভদ্রতার মুখোশটুকুও থাকে না। 

         ধর্মীয় পণ্ডিতদের বক্তব্যগুলির মধ্যে শ্রেষ্ঠ হচ্ছে ঈশ্বরের সৃষ্টি নিয়ে। তাদের বিশ্বাসের মূল ভিত্তি হচ্ছে যে, সৃষ্টিকর্তা দ্বারা সৃষ্টির আগে মহাবিশ্বের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। তিনি শূন্য হতে সব কিছু তৈরি করেছেন। কিন্তু এই ধরণের দাবী অযাচাই যোগ্য, ঈশ্বর যে ছিলেন তার প্রমাণ কেউ দিতে  পারেনি আজ পর্যন্ত আর পারবেনও না। আমরা কেমন করে জানবো এই মহাবিশ্বের সৃষ্টির  আগে ঈশ্বর অস্তিত্বশীল ছিলেন;  অথচ মহাকাশ মহাবিশ্ব কিছুই ছিল না। এটা সত্যি যে আজকের এই  মহাকাশ মহাবিশ্ব নীহারিকা তারকারাজির সর্বদা অবস্থিতি ছিল না। এগুলির সৃষ্টির কোনো উপাদান যদি মহাবিশ্বে বর্তমান না থাকতো তাহলে হঠাৎ করে ঈশ্বর কার থেকে এই গ্যালাক্সি নীহারিকা নক্ষত্রপুঞ্জ তৈরি করলেন? সুতারাং হঠাৎ করে এইসব ঈশ্বর দ্বারা তৈরি হয়েছে এই যুক্তি ধোপে টেকেনা। তার চেয়ে বরং পূর্ব থেকেই পরমাণুর অস্তিত্ব ছিল এটা মেনে নেওয়া সম্ভব। পরমাণুর সংযোগে সূর্যের ও অন্যান্য নক্ষত্রের উৎপত্তি ঘটে। কিন্তু এখনো পরমাণুর সংমিশ্রণ কেন ঘটে জানিনা। বিজ্ঞানীরা এই মহাবিশ্ব গঠনের কারণ অনুসন্ধান করে সার্নের গবেষণাগারে বোস হিগিন কণার সন্ধান পেয়েছেন। কিন্তু এনার্জি কি করে ভরে রূপান্তরিত হয় তা এখনও জানতে পারেনি।তবে এই অনুকল্পের প্রমাণ দেখা যায় মহাকাশে অবিরাম তারকারাজির উদ্ভবে ও মৃত্যুতে।

          তাই বলা যেতে পারে সৃষ্টির সূচনা পদার্থ থেকে নয় বরং এক বস্তু থেকে অন্য বস্তুতে রূপান্তর। এই পরিস্থিতিতে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বের পক্ষে যুক্তি দেখানো মুশকিল। আমরা যদি ধরে নিই যে, সর্ব শক্তিমান ঈশ্বর সৃষ্টির পূর্বে এই মহাবিশ্বের অস্তিত্ব ছিলনা তাহলেও সমস্যা দেখা দেবে, সেই সমস্যা হচ্ছে -

১) মহাবিশ্বের সৃষ্টির কারণ কি?

২) বিশ্বব্রহ্মাণ্ড আগে থেকে কেন ছিলনা?

৩) ঈশ্বর কেন বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির সিদ্ধান্ত নিলেন? 

     এইরকম বিভ্রান্তির মাঝে আমাদের পার্থিব মনে একটি ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে যায়। আমরা বুদ্ধিমান মানুষেরা পৃথিবীর অন্যান্য জীবের সাথে একই শ্রেণিতে বিন্যস্ত হতে রজি নই। বহু পূর্ব থেকেই মানুষ প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করতে না পেরে  ভয় থেকে বিশ্বাস করে আসছে এই বিশ্ব মহাবিশ্বে সবকিছু কেউ না কেউ একজন শুরু করছেন এবং তিনিই নিয়ন্ত্রণ করছেন  সকল শুভ ও অশুভ প্রভাব। এই ধারণার পক্ষে যুগ যুগ ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি বই লেখা হয়েছে, সঙ্গীত রচিত  হয়েছে, কাল্পনিক কথাবার্তা উপন্যাস রচিত হয়েছে এবং বিভিন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশে বিভিন্ন ধর্মের উদ্ভব ঘটিয়েছে। আদিম বা প্রগতিশীল বর্তমান সমাজেও ধর্মের দারুণ প্রভাব বিরাজমান। আদিম সমাজে কুসংস্কার ও মোহ ছিল চূড়ান্তরূপে। আবার আধুনিক প্রগতিশীল  সমাজে চিন্তাশীল ব্যক্তির প্রভাবে সভ্য এবং ন্যায় সঙ্গত সমাজ ব্যবস্থা কায়েম হয়েছে। চিন্তাবিদরা আবির্ভূত হয়েছে  আইন প্রণয়নকারী দার্শনিক, বিজ্ঞানী; সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ সমাজ সংস্কারকের রূপে। যেমন হাম্বুরাবি, কনফুসিয়াস, গৌতম বুদ্ধ, সক্রেটিস, এরিস্টটল, প্লেটো, আইনস্টাইন, রবীন্দ্রনাথ, ডিরোজিও  শত শত  মানুষের নাম করা যায়। আর মানুষ যে সমস্ত জিনিসে ভয় পেয়ে ঈশ্বর বা ধর্মের সৃষ্টি করেছেন তার অনেকটাই ব্যাখ্যাযোগ্য। এই মহাবিশ্বে সব ঘটনার একটা কার্য কারণ সম্পর্ক আছে, মানুষের পক্ষে হয়তো সব ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়নি, এটাইতো হবে আগামীতে, মানুষ চাইবেই প্রকৃতির এই জ্ঞান আহরণ করতে, তবেইতো সে অন্য জীবেদের থেকে পৃথক।

         ঈশ্বরের ইচ্ছা ছাড়া শুনেছি গাছের পাতাও নড়েনা। সত্যিই যদি ঈশ্বর  শক্তিমান সর্বজ্ঞ হোন, সমস্ত সৃষ্টির কর্তা হোন এবং চান যে তাঁর প্রতি সবাই বিশ্বাস আনুক বা সেমেটিকদের মতো ঈশ্বর প্রেরিত মেসেঞ্জার বা রসুল/নবীদের প্রতি সবাই বিশ্বাস আনুক এবং তার শিক্ষা গ্রহণ করুক তবে ঈশ্বরের সবচেয়ে সুবিধা হচ্ছে সবাইকে ভাল এবং বিশ্বাসী বানিয়ে এই পৃথিবীতে পাঠানো।  অন্যধারে উনিই যদি মানুষকে  পৃথিবীতে পাঠান তাহলে উনিই ভাল খারাপ মানুষ করে  পাঠিয়েছেন  এই পৃথবীতে;  তাহলে সবজান্তা ঈশ্বরের  মানুষকে পরীক্ষার জন্য বলাটা  একটু হাস্যকর হচ্ছেনা কি? বা ঈশ্বর নিজে ঐ মেসেঞ্জারদেরকে মানুষের মনের ওপর নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা দিতে পারতেন  তাহলে নবিকে ইসলাম গ্রহণের জন্য এতগুলি যুদ্ধ আর লোকক্ষয় করতে হতোনা; ক্রুসেডে এত লোক  নিহত হতো না। দুর্যোধনকে ভাল সৎ করে তুললে শ্রীকৃষ্ণের ভোজবাজি বিশ্বরূপ  অর্জুনকে দর্শন করাতে হতোনা; কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের এতো লোকক্ষয় হত না বা কংসকে   সৎ ভাল মনের করলে  দেবকী বাসুদেব  এত কষ্ট পেতেন না,  মৃত সত্যবানকে সাবিত্রীর  বাঁচিয়ে তুলতে হত না। এই  কঠিন প্রক্রিয়ায়  একজন মৃত ব্যক্তিকে পুনরায় জীবিত করা বা কুমারীর গর্ভে জন্ম নেওয়া বা  নদীকে দুভাগ করা বা চাঁদকে দ্বি-খণ্ডিত করা বা  মেরাজে করে সপ্ত স্বর্গ ভ্রমণ করানোর  ক্ষমতার চাইতে  অনেক  সহজতর। তখন দেব দেবী  বা ভগবানের দূত মুসা ঈশা আল্লাহর এই উদ্ভট অবৈজ্ঞানিক কাজ করার প্রয়োজনই পড়ত না। সারা পৃথিবীর সবাই ঈশ্বর বিশ্বাসী হয়ে যেত। তাহলে??

বাইবেল ও কোরানে মহাবিশ্বের সৃষ্টি -
শম্ভুনাথ চার্বাক
Nov. 23, 2024 | যুক্তিবাদ | views:284 | likes:2 | share: 2 | comments:0

বাইবেলের বর্ণনা অনুযায়ী ঈশ্বর আকাশ ও পৃথিবী ছয় দিনে সৃষ্টি করেন এবং সপ্তম দিনে বিশ্রাম নেন যা সাবাতের দিন নামে খ্যাত। বাইবেলের পুরাতন নিয়মের এই কথা প্রচন্ড ধার্মিক  ঈশ্বর বিশ্বাসী খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করেন। যেহেতু সৃষ্টির আগে সূর্যের অস্তিত্ব ছিলনা তাই বোধহয় সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত হতো না। আর পৃথিবী ও আকাশ সৃষ্টির সময়কে দিন (ছয় দিন) ধরে হিসাব করা স্পষ্টত অসম্ভব।

প্রশ্ন হচ্ছে - কেন ঈশ্বর মানুষের আবিষ্কার  করা সময়ের মাপদণ্ড দিয়ে তার সৃষ্টির সময়কে হিসাব করবেন? কেন তিনি পৃথিবী নামক গ্রহের সময়কে একক ধরে হিসেব করবেন? অন্যান্য দূরবর্তী গ্রহ ইউরেনাস বা নেপচুনের সময়কে একক হিসেবে ধরবেন না? ঈশ্বর সূর্য ও পৃথিবী সৃষ্টি করার আগের সময়ে দিন ও রাত কিভাবে সংঘটিত হতো?

          মহাবিশ্বকে ছয়দিনে সৃষ্টি করার কথা কোরানে কমপক্ষে আটবার আছে। এছাড়া আরবী শব্দ আরশ কথাটির অর্থ রাজসিংহাসন বিভিন্ন আয়াতে (৭:৫৪/২৫:৫৯/১১:৭/২৩: ৮৬-৮৭, ১১৬/৩২:৪) আল্লাহর আরশে বসার কথা বলা হয়েছে। 



প্রশ্ন হচ্ছে – নিরাকার আল্লাহ কি করে আরশে বসেন? নিরাকার জীব আল্লাহকে কেন আরশে বসতে হব? কোরানে স্পষ্ট বলা হয়েছে আল্লাহর আরশ আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির আগে পানির ওপর ছিল। তাহলে পৌত্তলিক আরবীয়ানদের আল্লাহই কি নবির আল্লাহ? নবির বাবার নাম ছিল আবদুল্লাহ, এর অর্থ আল্লাহর দাস এবং আবু লাহাবের নাম ছিল আব্দুল ওজ্জা যার অর্থ ওজ্জা দেবীর দাস। আর আকাশ পৃথিবী সৃষ্টির  আগেই আল্লাহর আরশ পানির ওপরে ছিল মানে কি? (সুরা ইউনুস – আয়াত ৩ ও সুরা আরাফের আয়াত ৪৪)। পৃথিবী সৃষ্টির আগে পানি আসে কোথা থেকে?  এটা সম্ভবত বাইবেলের কপি পেস্ট। এদিকে আল্লাহ নিজেই বলেছেন – আমি আকাশ পৃথিবী এবং দুইয়ের মধ্যবর্তী সব ছয়দিনে সৃষ্টি করেছি। ক্লান্তি আমাকে স্পর্শ করেনি (সুরা কাফ –আয়াত ৩৮)। তাহলে সর্বশক্তিমান আল্লাহরও নিশ্চয় ক্লান্তি আসে? এই আয়াতটি সত্যি বিস্ময়ের সৃষ্টি করে। বাইবেলে সপ্তম দিন অবশ্য বিশ্রামের দিন বলা হয়েছে।  নীচে মহাবিশ্ব সৃষ্টি সংক্রান্ত সুরা ও আয়াতের কিছু কিছু তুলে দিলাম যা বর্তমান কালে শুধুই হাসির উদ্রেক করবে।


১) তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ, যিনি আকাশ ও পৃথিবী ছয় দিনে সৃষ্টি করেন, তারপর তিনি আরশে সমাসীন হন। সুরা ইউনিস, আয়াত - ৭)

২) যখন তাঁর আরশ পানির ওপর ছিল তখন তিনিই আকাশ ও পৃথিবী ছয়দিনে সৃষ্টি করেন। (সুরা হুদ - ৭)

মনে প্রশ্ন জাগে - আকাশ জমিন সৃষ্টির আগেই সিং হাসন ও পানি কি করে ছিল?

৩) আমি আকাশ পৃথিবী এবং দুইয়ের মধ্যবর্তী সবকিছু ছয়দিনে সৃষ্টি করেছি, ক্লান্তি আমাকে স্পর্শ করেনি (সুরা কাফ - ৩৮)

এই আয়াতটি বিস্ময়কর ছেলে-মানুষি, সর্বশক্তিমান নিরাকার আল্লাহকে এ ধরণের বালখিল্লের মতো পরিচয়জ্ঞাপন বিভিন্ন প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়।

৪) বল তোমরা কি তাকে অস্বীকার করবে, যিনি দুদিনে পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন; আর তোমরা তার সমকক্ষ দাঁড় করাবে।(সুরা হামিম সিজিদা-৯)

৫) তিনি পৃথিবীর উপরিভাগে পর্বতমালা স্থাপন করেছেন ও সেখানে কল্যাণ রেখেছেন-(৪১:১০)

৬) তারপর তিনি আকাশের দিকে মন দিলেন, আর তা ছিল ধোঁয়ার মত। তারপর তিনি আকাশ ও পৃথিবীকে বললেন তোমরা কি স্বেচ্ছায় আসবে না অনিচ্ছায় - (৪১:১১)

৬) তারপর তিনি আকাশকে সাত আকাশে পরিণত করলেন আর প্রত্যেক আকাশকে তার কাজ বুঝিয়ে দিলেন(৪১:১২)। এই আয়াতে অতিরিক্ত দুটি দিনের কথা বলা হয়েছে যা আকাশকে সজ্জিত করার জন্য ব্যয় হয়েছে।

- এই আয়াত কোরানের ছয় দিনের সাথে সাংঘর্ষিক। এত বিশৃঙ্খলা সবজান্তা আল্লাহর কাছে আশা করা যায় না। সুরা তওবার দিনপঞ্জি সংক্রান্ত আয়াতটিও বড্ড গোলমেলে

আবার একটি আয়াতে বলা হয়েছে যে – অবিশ্বাসীরা কি ভেবে দেখে না যে আকাশ ও পৃথিবী ওতপ্রোতভাবে মিশেছিল? তারপর আমি উভয়কে পৃথক করলাম (সুরা আম্বিয়া ৩০) একে অনেক ইছলামিক পণ্ডিত বিগ ব্যাং থিওরী বলে চালাতে চায়। এরা জানেনা যে বিগ ব্যাং এর হাজার কোটি বছর পরে পৃথিবীর সৃষ্টি হয়েছে।

সব ধর্মগ্রন্থেই এইরকম গ্যাজাখুড়ি আছে। তবে ধর্ম মোহে আক্রান্ত   কিছু ধীমান  মানুষের গোল গোল ব্যাখ্যা আজ আর সবাইকে সন্তুষ্ট করতে পারছে না।

 এই গোঁজামিল থাকাই স্বাভাবিক, কারন তখনকার দিনের লোকদের হাতে উন্নত টেলিস্কোপ ছিলনা আর মহাকাশ বিজ্ঞানের এত প্রসার ঘটেনি। হিন্দু ধর্মগ্রন্থে মহাবিশ্ব সৃষ্টির ঘটনাতেও এই জলের কথা বলা আছে সেটা অনেকদিন আগেই আমি পোস্ট দিয়েছিলাম। আর কোরানের বাক্যগুলি এমনই যে কোনটা কে বলেছে সেটা না বুঝতে পারার মতো নয়।  নবি হজরত মুহাম্মদ এই ব্যালেন্সটা রাখতে পারেননি। বেশ কিছু আয়াতে তিনি ধরা পড়ে গেছেন যে এগুলি ওনারই বক্তব্য।

রেনেসাঁসের অন্যতম প্রমিথিউস বিদ্যাসাগর -
শম্ভুনাথ চার্বাক
Nov. 21, 2024 | জীবনী | views:891 | likes:2 | share: 2 | comments:0

বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের কাজ ছেড়ে দিলেন সম্পাদক রসময় দত্তের সাথে বনিবনা না হওয়ার জন্য। রসময় দত্ত আড়ালে বলতে লাগলেন, বিদ্যাসাগর যে চাকুরিটা ছেড়ে দিলে, খাবে কি? 

এই কথা বিদ্যাসাগরের কানে পৌঁছুলে তিনি বললেন, রসময়বাবুকে বলো তিনি আলু পটল বেচে খাবেন। জীবিকার জন্য যেকোন স্বাধীন বৃত্তি তিনি নিতে পারতেন। স্বাতন্ত্র্য ও ব্যক্তিস্বাধীনতা ছিল তাঁর আত্মমর্যাদা বিচারের অন্যতম মানদণ্ড। সমস্ত শাস্ত্র অধ্যয়ন করা বিদ্যাসাগরের আলু পটল বেচতেও কোনো অসুবিধা হতো না। 

তখন তাঁর বাসায় আশ্রিতের সংখ্যা অনেক। অসহায় দরিদ্র আত্মীয়স্বজনের প্রায় কুড়িটি ছেলের খাওয়া পড়ার দায়িত্ব তাঁর কাঁধে; এছাড়াও অনেক দায়িত্ব তিনি মাথায় নিয়ে চলতেন। কিন্তু স্বাধীনভাবে অর্থোপার্জোনের পথ কোথায়? আলু পটলের ব্যবসা করার মতোও তাঁর নিজস্ব কোনো মূলধন ছিল না। বিদ্যাসাগরের মূলধন ছিল বিদ্যা, বিদ্যাই তাঁর স্বোপার্জিত মূলধন এবং তিনি ছিলেন বিদ্যার ব্যাপারী। কিন্তু বিত্তের সাথে বিদ্যার সাদৃশ্য কোথায়? বিশেষ করে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে? বিত্ত দান করলে কমে, কিন্তু বিদ্যা দান করলে বাড়ে। স্বাধীন বাণিজ্যবৃত্তির দৃষ্টান্ত তাঁর পূর্বে রামমোহন রায়, দ্বারকানাথ ঠাকুর এবং সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক তারানাথ তর্কবাচস্পতি ও কয়েকজন শাস্ত্রজ্ঞ বাঙালি পণ্ডিতদের মধ্যেও এটা দেখা গিয়েছিল। অনেক ইয়ং বেঙ্গল সদস্যরা এই স্বাধীন ব্যবসার পথে দেখিয়ে গেছেন। এটা রেনেসাঁসের একটা অন্যতম লক্ষণ। বিদ্যাসাগরও নিজের বিদ্যাকে মূলধন করে তারই যুগোপযোগী বাণিজ্যের জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন, সেদিক থেকে তিনিই বাংলাদেশে ও ভারতে এই ব্যবসায়ের অন্যতম পথপ্রদর্শক। 

এতদিন পর্যন্ত হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি ছিল পাতালের অন্ধকারে শৃঙ্খলিত প্রমিথিউসের মতো। মুদ্রণযন্ত্র তাকে মুক্তি দিল যেদিন এবং সেদিন জ্ঞানের আলোক চারিদিকে পরিব্যপ্ত হল এবং অজ্ঞানের অন্ধকার ধীরে ধীরে কাটতে লাগল। পুরোহিত যাজক ইমামমদের পুঁথিগত জ্ঞান হাতেলেখা পাণ্ডুলিপির কারাজীবন থেকে মুক্ত হয়ে সকল মামুষের আয়ত্তের মধ্যে এল ছাপার অক্ষরে। কুসংস্কার ও কূপম্পন্ডুকতার কারাগার থেকে মানুষের মুক্তির জন্য যে স্বপ্ন বিদ্যাসাগর দেখেছিলেন, তা হাতে লেখা পাণ্ডুলিপির সাহায্যে সম্ভব নয়। মূদ্রিত বইয়ের ভূমিকা অন্য কিছুই পুরণ করতে পারেনা সেই সময়ে। মুদ্রনযন্ত্র তাই নবযুগের জ্ঞান বিদ্যার প্রমিথিউস। গুরুগৃহের জীর্ণ-সংকীর্ণ দেয়াল ভেঙে জনসমাজের মুক্তাঙ্গনে জ্ঞানবিদ্যার আলোকবর্তিকা বহন করে নিয়ে আসার প্রচন্ড শক্তি যে মূদ্রণযন্ত্র ধারণ করে, সে এযুগের প্রমিথিউস বৈ কি? নবযুগের জ্ঞান তথাকথিত কল্পিত স্বর্গের অপহৃত প্রমিথিউসের অগ্নির মতো। 

এই মুদ্রিত বই ছিল বিদ্যাসাগরের জীবনের মুক্তির প্রতীক। সংস্কৃত কলেজ ছাড়ার আগেই তিনি সংস্কৃত প্রেস ও ডিপোজিটারি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। 


মদনমোহন তর্কালঙ্কার ও বিদ্যাসাগরের সমান অংশীদ্বারিত্বে এই প্রেস স্থাপিত হয়েছিল। এই দুই বন্ধু ছিলেন একই বৃন্তে দুটি ফুলের মত। শিক্ষা প্রসার ও সামাজিক কুসংস্কার নিবারণের জন্য ওনারা দুই বন্ধু লেখা শুরু করেছিলেন।

 এনাদের বন্ধু বাবু নীলমাধব মুখোপাধ্যায়ের থেকে ৬০০ টাকা ধার করে দুজনে এই পুরানো প্রেস ক্রয় করেন। বিদ্যাসাগর ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের ইংরেজ সিভিলিয়ন ছাত্রদের বাংলা শিক্ষার জন্য অন্নদামঙ্গল কাব্য কৃষ্ণনগরের রাজবাড়ি থেকে এনে ছাপিয়ে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ থেকে ৬০০ টাকা পেয়েছিলেন। সেই অর্থে নীলমাধব বাবুর ধার পরিশোধ হয়। এই অন্নদামঙ্গল কাব্যই প্রথম বই যা ওনাদের প্রেস থেকে বেরোয়। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের জন্য আরো অনেক বই ছাপান। এর পর যে সমস্ত পুঁথি মুদ্রিত ছিলনা সেগুলি ছাপাতে শুরু করেন। সংস্কৃত কলেজে ও অন্যান্য লোকেদের কাছে সেগুলি বিক্রি করে লাভের মুখ দেখেন। বিদ্যার দুর্ভেদ্য গর্ভগৃহ থেকে পুথিবন্দি সাহিত্য দর্শন ইত্যাদির জ্ঞানভাণ্ডার মুদ্রিত গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেন। 

বাণিজ্যক্ষেত্রে সে যুগে মুদ্রক প্রকাশক ও পুস্তক বিক্রেতার স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠা হয়নি। মুদ্রিত বইয়ের জন্য প্রকাশকদের তখনও পৃথক দোকান খুলে বিক্রির প্রয়োজন দেখা দেয়নি। কিন্তু এদেশে ছাপা বইয়ের চাহিদা ক্রমশ বাড়ছিল পাঠকমহলে। তখন কলকাতার চীনা বাজারই ছিল সব থেকে বড় বইয়ের ব্যবসার কেন্দ্র। অন্যেরা ক্যানভাসারদের দিয়ে বই বিক্রি করতেন। কিন্তু বিদ্যাসাগর কলেজষ্ট্রীটে সংস্কৃত প্রেস ডিপজিটারি নাম দিয়ে প্রথম বইয়ের দোকান করলেন এবং নিজের লেখা ও ছাপাখানায় মুদ্রিত প্রকাশিত বই ছাড়াও অন্য লেখকদের বইও বিক্রি করতে শুরু করলেন। বিদ্যাসাগরই সম্ভবত এই অঞ্চলের প্রথম গ্রন্থ ব্যবসায়ী এবং যা আজ মহীরুহে পরিণত হয়েছে। মুদ্রণের টেকনিক্যাল ব্যাপারেও উনি কতটা আগ্রহী ছিলেন তা ওনার অক্ষর বিন্যাস দেখেই বোঝা যায়। এরপর গিরিশচন্দ্র নিজের নামে একটি মুদ্রণযন্ত্র স্থাপন করে ব্যবসা শুরু করেন। 

বাংলাদেশের জমিদার ও পণ্ডিতদের একটি বড় অংশ মুদ্রণের প্রসার কামনা করতেন না। পণ্ডিত পুরোহিতদের কুক্ষিগত শাস্ত্রবিদ্যা গ্রন্থাকারে জনসাধারণের মধ্যে প্রচারিত হুলে তাদের বংশগত শাস্ত্রবিদ্যার ব্যবসা নষ্ট হয়ে যাবে, এই ছিল তাদের ভয়। 

মুদ্রণের ঐতিহাসিক তাৎপর্য বুঝেই বিদ্যাসাগর অন্য কোনো স্বাধীন বাণিজ্যের প্রতি আকৃষ্ট হননি। কারণ আর্থিক আত্মনির্ভরতাই তাঁর একমাত্র কাম্য ছিল না। তাঁর লক্ষ্য ছিল, জীবনের স্বাধীন বৃত্তিকে জীবনের ব্রতের অবিচ্ছেদ্দ অঙ্গ করে তোলা। শিক্ষা ও সমাজ সংস্কার যার জীবনের ব্রত, স্বাধীন মুদ্রক প্রকাশক ও গ্রন্থাকারের বৃত্তিই তার শ্রেষ্ট উপযোগী বৃত্তি। বাংলা তথা ভারতে জ্ঞানকে কারাগারের অন্ধকার মুক্ত করে আলোতে নিয়ে আসার প্রমিথিউস বিদ্যাসাগর ছাড়া আর কে? 

বিদ্যাসাগরের জন্ম মাসে ওঁকে আমার শতকোটি প্রণাম ও শ্রদ্ধাঞ্জলি।

অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার এর জাঁতাকল বাড়ছে -
শম্ভুনাথ চার্বাক
Nov. 21, 2024 | সমাজ | views:286 | likes:2 | share: 2 | comments:0

দুর্গা দুর্গা, সাবধানে যেও, এইরে পল্টুর মা এই সময়ই তোমার হাঁচি পেলো! একটু দাঁড়িয়ে যা বাবা। রিন্টু বাবা  চিন্তা করিসনা তোর বাবা ঠিক সেরে উঠবেন, যে ধন্বন্তরী ডাক্তার অস্ত্রোপচার করবে তাঁর হাতে আমাদের এখানে অনেক রোগী সুস্থ হয়েছে। সত্য সত্য সত্য, দেখ টিকটিকি টক টক করে সত্য ঘোষণা করলো।  বোনপো রিন্টু আর ওর যুক্তিবাদী বন্ধু এসেছে বর্ধমান দুর্গাপুর থেকে। চিনার পার্কে মাসি বাড়িতে উঠেছে বাবাকে নিয়ে অ্যাপোলো হাসপাতালে  চিকিৎসা করাতে। মাসির কথা শুনে বেরোতে গিয়েও দাঁড়িয়ে পড়লো। কিরে, থেমে গেলি কেনো? ঐযে মাসি দেখনা এক শালিক, দাঁড়াও আর একটা শালিক আসুক তারপর বেরবো। একটু পরেই আরো তিনটে শালিক একসাথে এল। ছেলেটি বেরোবে এমন সময় মাসি বললো, বাবা ভুলে গিয়েছিলাম একদম, গতকাল ঠাকুর বাড়ি গিয়ে এই ফুল বেলপাতা আর মাদুলিটা নিয়ে এসেছিলাম, এটা জামাইবাবুর হাতে বেঁধে দিস। রিন্টুর  বন্ধুর মুখ সারাক্ষণ  ভার হয়ে আছে এইসব  দেখে; রিন্টুও বুঝছে সেটা। কিন্তু কিছুই  করার ছিলনা বলে এই যুক্তিবাদী পরপোকারি বন্ধুকে নিয়ে। মাসি কি বলছো?অস্ত্রোপচারের আগে দেহের সব কিছু খুলে নেবে না হলে ইনফেকশন হতে পারে। তাহলে  বাবা, আচ্ছা জামাইবাবুর মাথায় ঠেকিয়ে জামাইবাবুর বিছানার নীচে রেখে দিস। এই তোর পায়ের কালো কারটা ঠিক মতো বাঁধ, খুলে যাবে যে। আচ্ছা মাসি, এবার চলি দেরী হয়ে যাবে। নিজেদের গাড়িতেই এসেছে এবং গাড়িতে উঠেই পায়ের কালো কার ঠিক করে নিল, গাড়ি নিয়ে অ্যাপোলো হাসপাতালের দিকে এগোচ্ছে। হঠাৎ করে একটা জোরে ব্রেক কষলো, একটা কালো  বেড়াল দ্রুত গতিতে রাস্তা পার হলো। আর একটু হলেই দুর্ঘটনা ঘটতো। রিন্টু ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলল; তারপর গাড়ি  থেকে নেমে আকাশের দিকে তাকিয়ে নমস্কার করল। রিন্টুরা ধনী মানুষ, রিন্টুর হাতের আটটা আঙুলেই জ্যোতিষের দেওয়া  নিলা, পলা, গোমেদ, রুবি প্রভৃতির আঙটি। বুড়ো আঙ্গুলে পরা যায়না তাই পরেনি।  ওর বন্ধুর মুখের অবস্থা দেখে তাড়াতাড়ি গাড়িতে এসে বসল।

    এদিকে ওর হাসপাতালে পৌঁছতে দেরী হয়ে গেছে, ওর বাবাকে অস্ত্রোপচারের জন্য অ্যানা স্থিসিয়া দেওয়া হয়েছে, একটু পরেই  অপারেশন  রুমে নিয়ে যাবে। রিন্টু বাবার মাথায় মাদুলি –ফুল দুর্বা ঠেকিয়ে বিছানার নীচে রেখে দিল। এমন সময় ডাক্তারবাবু  ও স্টাফেরা এলেন  পেশেন্ট কে অপারেশন  রুমে  নিয়ে  যাওয়ার  জন্য। রিন্টু ডাক্তারবাবুকে দেখে  বাবার অবস্থার খোঁজ নিয়ে ডাক্তারবাবুকে শুধলো, বাবা সেরে উঠবেনতো? ডাক্তারবাবু বললেন, দেখুন  আমরাতো শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করি, বাকিটা  ওপরওয়ালার হাত। ঈশ্বরকে ডাকুন তিনিই আপনার বাবাকে সুস্থ রাখবেন। বন্ধুটি বলে উঠল আমরা পেশেন্ট কে আপনাদের ভরসায় এনেছি, ওপরওয়ালার ভরসায় নয়। রিন্টু বলল কি আজেবাজে বকছিস। বন্ধুটি বলল ওপরওয়ালার  ভরসায় এতদূর এত দামী হাসপাতালে আনার দরকার  কি?  তোদের কথাতে ওপরওয়ালা সর্বত্র  বিরাজমান ; দুর্গাপুরেও নিশ্চিত  ওপরওয়ালা আছে?  ডাক্তারবাবু বোধহয় একটু হকচকিয়ে গিয়েছিলেন; তারপর  যুক্তিবাদী বন্ধুর দিকে এমন একটা তীর্যক দৃষ্টি হেনে  অপারেশন রুমে চলে গেলেন। রিন্টু আকাশের দিকে তাকিয়ে অদৃশ্য ঈশ্বরকে প্রণাম জানিয়ে বন্ধুকে নিয়ে  রিসিপশানে এসে বসলো। সেখানে বিশাল টি ভী তে সাঁই বাবার বিভূতি দেওয়ার দৃশ্য দেখানো হচ্ছে। এখন প্রতি হাসপাতালেই দেবদেবীর থানে ভরা।  রিন্টুর বন্ধু এসব দেখে বলল এবার হাসপাতালে না নিয়ে  মন্দির মসজিদ গির্জাতে নিয়েই চিকিৎসা করালে হয়। দুজনে নানান কথা আলোচনা করছিল প্রায় তিন ঘন্টা ধরে। মাঝে একবার হাসপাতালের ক্যান্টিন থেকে চা পান করে এসেছে। হঠাৎ রিন্টুর নামে ঘোষণা হলো, রিন্টুকে কর্তৃপক্ষের সাথে  দেখা করতে বলছে। রিন্টু ওর বন্ধু  ভয়ে ভয়ে ডাক্তারের কাছে গেল। ডাক্তারবাবু ওদের বসতে বললেন  এবং  বললেন, আপনার বাবার অবস্থা খুব ক্রিটিকাল, ভেন্টিলেশানে দেওয়া হয়েছে, ওনার  কোভিড হয়ে গেছে ----আমরা সর্বোতভাবে চেষ্টাই করছি, তবে বলতে পারছি না। এখন বাঁচা মরা সব ওপরওয়ালার হাতে।

     আপনি বলতেই পারেন সোস্যাল মিডিয়া, ফেসবুকে যা খুশী লেখা যায় বলে আপনি হাজার হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা সংস্কারে খোঁচাখুঁচি করছেন। আর এইসব সংস্কার, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লিখলেই কি মানুষ কুসংস্কার অন্ধবিশ্বাসের গহ্বর থেকে উঠে আসবে?  শ্রাদ্ধানুষ্ঠান বা মৃত্যুভোজ তুলে দেবে, সমস্ত অনুষ্ঠান থেকে ব্রাহ্মণ পুরোহিত বর্জন করবে, জ্যোতিষবিদ্যা, গ্রহরত্ন, হস্তরেখা বিচার, মাদুলি কবচ  জলপড়া ইত্যাদির ওপর মানুষের নির্ভরশীলতা কমবে? না, আমরা এসব এক্কেবারেই ভাবিনা যে আমার ফেসবুকের লেখা দেখে সবাই কাল থেকে পূর্বজন্ম, পরলোক, হাঁচি, দু’শালিক, বেড়ালের রাস্তা কাটা, কবচ মাদুলি, কালো কার লাল সুতো সম্পর্কে আমার ফেসবুকের বন্ধুরা অবিশ্বাসী হয়ে উঠবে। তবুও প্রচন্ড জলস্রোতের বিপক্ষে মাছেরা সাঁতার কাটে, জিওনার্দো ব্রুনোরা শয়তানদের আগুনে জ্যান্তো পোড়েন, চার্বাকেরা নির্মূল হয়ে যান ব্রাহ্মণ  পুরোহিতদের রোষে; গ্যালিলিওরা কারাগারে অবরুদ্ধ হয়ে জীবন দেন, সক্রেটিসেরা হেমলকে জীবন দেন। 

    সমাজের সমস্ত অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার এবং সংবেদনশীলতা একদিনে তৈরী হয়নি। হাজার হাজার বছর ধরে প্রতিকূল প্রাকৃতিক শক্তি সম্পর্কে অজ্ঞতা, ভয় ভীতি অসহায়তা আদিম মানুষের মনোজগতে ধীরে ধীরে নানা অলৌকিক অবাস্তব কল্পনার সৃষ্টি করেছে। সমাজ বিকাশের বিভিন্ন পর্যায়ে স্বার্থান্বেষী ধীমান মানুষের প্রশ্রয়ে শাখা প্রশাখা শিকড় বাকড় ছড়িয়ে প্রসারিত হয়েছে মানুষের কোশে কোশে রন্ধ্রে রন্ধ্রে ধমনীতে ধমনীতে, অর্জন করেছে সামাজিক ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব। এবং মানুষের বেঁচে থাকার বাধাগুলির বিরুদ্ধে মানুষের অন্ধ আবেগ, ক্রোধ, ঘৃণা, আক্রোশকে প্রশমিত করতে কিছু মানুষ এই ভ্রান্ত বিশ্বাসকে পুঁজি করে অবিজ্ঞানকে সচেতন ভাবে বিস্তার করে গেছে। তাই অ্যাস্ট্রো-ফিজিক্সের অধ্যাপক ক্লাশে সূর্য গ্রহণ বা চন্দ্র গ্রহণ ছাত্রদের পড়িয়ে গ্রহণের দিন নিরম্বু উপবাস করে গ্রহণের পরে কীর্ত্তনীয়াদের সাথে গঙ্গায় স্নানে যায় পবিত্র হতে, ডাক্তারবাবু নিজের দায়িত্ব কমিয়ে ঈশ্বরের ওপর দায়িত্ব দিয়ে দেন, পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়ণের অধ্যাপকেরা মারকিউরাস ক্লোরাইড, অ্যালুমিনিয়ামের পাতের সংযোগে উৎপন্ন  আতর মেশানো ছাই বা বিভূতি নেওয়ার জন্য সাঁই বাবার আশ্রমে হুমড়ি খান।

    

আমাদের দেশের সুপ্রাচীন লোকায়ত বেদে বলা আছে --- “কায় শরীর  অঞ্চতি রক্ষতি কবচ “---- অর্থাৎ শরীরকে যে রক্ষা করে সেই কবচ। যেমন শীতবস্ত্র শীতের কবচ। পরবর্তী শ্রেণি বিভক্ত জাতপাতে বিভক্ত সমাজকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য ধীমান শাসক পুরোহিত শ্রেণি সমাজকে অনশবিশ্বাস, কুসংস্কার ও বিভিন্ন আচারে মুড়িয়ে দেয়। কবচের অন্য অর্থ  করে  ----  ধাতুর খোলে দেবদেবীর নাম লেখা কাগজ এবং ফুল দুর্বা ঢুকিয়ে ধারণ করাকেই কবচ বলেন, এই কবচের মধ্যেকার বীজমন্ত্র জীবনকে রক্ষা করবে। শ্রেণি বিভক্ত সমাজে আর্থিক সামাজিক নিরাপত্তাহীন, রোগ শোক, দুর্বিপাকে বিপর্যস্ত মানুষের দুর্বল মানসিকতাকে সাইকোথেরাপির সাহায্যে মোহাবিষ্ট করে ঐসব কবচ মাদুলি রত্ন বিকিকিনি করে লাভবান হন জ্যোতিষ বা রত্ন ব্যবসায়ীর মতো  সমাজের গুটিকয় মানুষ আর সর্বসান্ত হয় অধিকাংশ দুর্বল মানুষ। জ্যোতিষেরা অপরের ভাগ্য ফেরান আর নিজেদের ভাগ্য ফেরাতে বিজ্ঞাপন দেন খবরের কাগজে দূরদর্শনে। সমাজে নানান বাবাদের প্রাদুর্ভাভাব  আগের তুলনায় বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। মানুষ  যন্ত্রের প্রভাবে  ক্রমশ নি:সঙ্গ একা  হয়ে যাচ্ছে। টলমল সমাজে মানুষ সংঘবদ্ধতা থেকে একাকী হয়ে গেলে  জ্যোতিষ  ওঝা এবং বিভিন্ন বাবাদের মায়েদের প্রাদুর্ভাব  আরো বাড়বে আগামীতে।  চতুর শিল্পপতি ও ধনীরা দূরদর্শনে রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ বামাখ্যাপা রামপ্রসাদ লোকনাথ  রাসমণির মতো  সিরিয়াল দূরদর্শনে আরও বাড়িয়ে দেবেন। এফএম এ কালী কথা কৃষ্ণ কথা শিব মাহাত্ম্য র প্রোগ্রাম আরও বাড়াবে। এগুলো ঢাল হিসেবে কাজ করবে।

  

   আমার খাবারের থালায় প্রতিদিন একমুঠো করে ভাত কমে যাচ্ছে, বাবার  কারখানা অফিস বন্ধ ছাঁটাই চলছে, অর্ধশিক্ষিত ভাইটা কর্মহীনতার অন্ধকারে নিভিয়ে ফেলছে উদ্ধত আলোক শিখার মতো যৌবনশক্তির মহা উত্তাপ, আমার যুবতী বোনটার নাকের কাছে রুমাল দুলিয়ে নিয়ে যাচ্ছে শয়তান অন্ধকারের দেশে, আমার সন্তানের শিক্ষা, চিকিৎসা, স্ত্রীর রক্তহীন পান্ডুর মুখ, মৃত্যুর জন্য অপেক্ষারত অসুস্থ পিতা মাতার দীর্ঘশ্বাস এবং নিরুচ্চারিত অস্তিত্ব, মুখের সামনে বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানা, ইংরাজীতে এম এ এবং বি এড পাশ সোনার পুরের শান্তনু মিস্ত্রির আত্মহত্যার খবরে, পিএসসি, এসএসসি তুলে দেওয়ার খবরে বা রাজ্যের সমস্ত চাকুরি  20-30 লক্ষ টাকাতে বিক্রির খবরে ক্রমে ক্রমে নিভে আসছে বিবর্ণ পৃথিবীর অপসৃয়মান আলো। -  কী  সীমাহীন অন্ধকার আর ক্রোধ, আমার ভালো অথবা খারাপ অবস্থার জন্য দায়ী নিয়ন্ত্রকগুলির ওপর আমার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। সম্পূর্ণ অনিশ্চিয়তার জীবনের জন্য আমি কাকে দায়ী করবো? 


সারাদিন টিভির পর্দায় রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ, বামাখ্যাপা, সাইবাবা, সারদামণি, শ্রীরাম এবং জ্যোতিষেরা বশীকরণ মন্ত্র দিয়ে সব আয়ত্তে এনে দেবে, হনুমান চল্লিশা ব্রেসলেটের বিজ্ঞাপন মানুষকে দাবিয়ে রেখেছে। ঐতিহ্যের নামে কুসংস্কার আর অজ্ঞতাকে মহিমান্বিত করে বিশাল দুঃখ আর ক্ষোভকে তাবিজ-কবজ, রত্ন, পাথর আর অদৃষ্টবাদের গোলকধাঁধায় হারিয়ে দিতে চায় --- আমি কি তাদের কাজের প্রতিবাদ করবো না?

পূজা প্রার্থনা বা নামাজ পড়ে দেশের উন্নতি হয়েছে? -
শম্ভুনাথ চার্বাক
Nov. 20, 2024 | নাস্তিকতা | views:815 | likes:2 | share: 2 | comments:0

পূজা প্রার্থনা বা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে কি পৃথিবীর কোন ব্যক্তির বা গোষ্ঠীর বা দেশের উন্নতি হয়েছে?  এর প্রমাণ কি কেউ দিতে পারবে? অনেককে দেখেছি সারা জীবন ভক্তিভরে নিয়ম মেনে পূজা আর্চা করার পর শেষ জীবনে প্রায় ছয় মাস কোমাতে থেকে মারা যেতে। আবার একজন মুসলিম ভদ্রলোককে দেখতাম নিয়ম করে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার পর একদিন ট্রাক চাপা পড়ে হাসপাতালে দুর্বিসহ অবস্থায় কদিন কাটিয়ে মারা গেছেন। তার ছেলে কলকাতার হাসপাতালে তার সাথে দেখা করতে যাওয়ার পথে ভিড় ট্রেনের থেকে পড়ে মারা যায়। তাহলে প্রার্থনার ফল কি?

   আমাদের ছোটবেলায় মা বাড়িতে বিপদতাড়িনি ও বিপিনাশিনীর পুজো করতেন প্রতি আষাঢ় মাসে, এছাড়াও নানান ব্রত করতেন। কিন্তু মা মাত্র ৬৬ বছর বয়সে প্রচুর রোগে ভুগে মারা গিয়েছিলেন।পুজো করে কি আদৌ কোন ফল হয় বা হয়েছে?  কোনো বিপদ কেটেছে?  আসলে ভগবান থাকেন  ধনীদের গৃহে; সেখানে ধনীর সম্পদ বাড়ান  গুনিতক হারে। আদানি আম্বানি বিড়লা --------- প্রভৃতিদের দেখুন। ওরা পুজো নামাজ প্রেয়ারে  সাধারণ মানুষকে  ডুবিয়ে রাখতে চায়। এতে ওদের দুদিক  থেকেই লাভ  হয়। একদিকে নিজের দ্রব্য বিক্রি আর একদিকে শ্রমিকদের  মধ্যেই ধর্মীয় বিভেদ তৈরী করে  শ্রমিকদের দাবী দাওয়ার  আন্দোলন ভাঙ্গার জন্য।  গরিব মধ্যবিত্তরা পুজো ঈদ  বড়দিন বা অন্য ধর্মীয় অনুষ্ঠান উৎসবে    যা  খরচ করে তার সিংহ ভাগ ধনীদের কাছেই যায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে।  নোয়াখালী দাঙ্গার  পরেই ভয়ে বাংলাদেশের চট্টগ্রামের  মিরসরাই  থেকে  কলকাতায় সেটেল হয়ে   আমাদের এতগুলি ভাইবোনকে মানুষ করতে করতে মা  প্রচণ্ড লড়াই করে ক্ষয়ে গেছেন।  দেশভাগে বিপর্যস্ত উদ্বাস্তু  পরিবারকে প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে মা অনেকটা দায়িত্ব  নিজের কাঁধে  বয়ে নিয়ে গেছেন। উদ্বাস্তু না হলে উদ্বাস্তু শব্দের  অর্থ  পরিস্ফুট হয়না।  আমাদের জীবনে যা কিছু হয়েছে মায়ের অবদান তাতে সিংহভাগ; বাবা সেই অর্থে সংসার সন্যাসী, সমস্ত ব্যাপারেই উদাসীন  এবং ঠাকুর দেবতা নিয়ে বেশ একটু নির্বিকারই ছিলেন । মা সংসার নিবেদিত প্রাণ ছিলেন ফলে চরম অনিযম করে  মা মাঝে মাঝে অসুস্থ হতেন, হাসপাতালে ভর্তি হতেন।  কোনোদিন পুরো সুস্থ ছিলেন না। কিন্তু প্রতি আষাঢ় মাসের মঙ্গল ও শনিবার পুরোহিত ডেকে পুজো করতেন ভক্তিভরে  এবং লাল কালো তাগাতে হাত ভরে থাকতো, শুধু তাই নয় বাড়িতে মনসা লক্ষ্মী কার্তিক সরস্বতী  সূর্য পূজা এবং আরো অনেক ব্রত হতো। তাবিজ কবজ  মাদুলিও কম করেননি। কিন্তু মায়ের কোন বিপদ কাটেনি বা  বিপদ নাশ হয়নি। আবার  অসুস্থ হলে মন্দিরেও  হত্যে দিতে যাননি, বারেবার  হাসপাতালেই গিয়েছিলেন।  এইসব দেখে ছোটবেলা থেকেই আমার বিশ্বাস ভঙ্গ হয়েছিল। মা আবার  দেওয়ানগাজি  এলাকার পীরের থানেও প্রদীপ জ্বালাতেন, ফল কি?   শূন্য  ঋণাত্মক। আমি বলতাম কবজ তাবিজ মাদুলি বিপদতাড়িনীর তাগা পরেও তোমার বিপদ কাটছেনা; ওসব ছেড়ে দাও। এর ফলশ্রুতিতে পরবর্তীকালে অবশ্য সব পূজা আর্চা কবজ মাদুলি তাগা  বাদ দিয়েছিলেন এবং আমাদের বাড়ি সর্বধর্মের  বন্ধুদের জন্য উন্মুক্ত ছিল। আসলে এই রাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোয় মানুষের জীবন বিপর্যস্ত এবং ভয় অনিশ্চয়  ও  সংশয়ে ভরা।  সামন্ততান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে মানুষের নিদারুণ  অসহায় অবস্থা মানুষকে দুর্বল করে দেয় ফলে বিশ্বাস ভয়  মাথায় চড়ে বসে এবং সেই ভয় থেকেই ভক্তি তৈরি হয় এবং তারপর ঐ  ভক্তিকে কেন্দ্র করে শুরু  হয় পূজার নামাজের  ব্যবসা।গড়ে ওঠে মন্দির মসজিদ গির্জা, তৈরি হয় পুরুত ইমাম  পাদ্রী। আসে রাজনীতি এবং ধর্ম ও রাজনীতি মিলেমিশে একাকার হয়ে  যায়, মানুষের জীবনকে করে তোলে দুর্বিসহ।  

                             প্রতিটি ধর্ম তৈরির সময় সমাজ ছিল অস্থির অভাবে ভরা এবং মানুষের জ্ঞানও ছিল একদম আদিম স্তরে। প্রকৃতি সম্পর্কে অজ্ঞতা ও ভয় থেকেই চিন্তা করতে পারা একমাত্র জীব মানুষের ধর্ম জন্ম নিয়েছে । প্রকৃতির আর কোন জীব ধর্মপালন করেনা; সুন্দরবনে হিন্দু বাঘ বা মুসলিম শুয়োর বা খ্রিস্টান হাতি দেখেছেন??। ধর্ম আবিষ্কারের পরেই এটাকে নিয়ে ব্যবসা শুরু হয়েছে বুদ্ধিমান মানুষের দ্বারা । সবাই নিজের লোক বাড়াতে চেয়েছে ভয় অথবে অস্ত্রের জোরে। মুহাম্মদের মদিনার জীবনী রাজনীতি ছাড়া কি??  রাজানুগ্রহ না পেলে কোনো ধর্মই এমনভাবে প্রসারিত হতোনা । সম্রাট অশোকের সহায়তা না পেলে বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার লাভ হতোনা। গুপ্ত রাজাদের সহায়তা না পেলে হিন্দু ধর্মও পুন:প্রতিষ্ঠা করা মুশকিল ছিল। সব ধর্মের ইতিহাসই প্রায় এক এবং ধর্মগ্রন্থগুলি  রূপকথা  ভয় লোভ দেখানো ঘৃণা হিংসায় ভরা  রক্তাক্ত। আমিই    ঘোর  নাস্তিক  বোধহয় ভারতের প্রায় সব রাজ্যের অধিকাংশ বড় বড় তীর্থস্থানে ঘুরেছি একফোটা ধর্ম বিশ্বাস না নিয়ে । তবে  ভারতের নামী তীর্থস্থান গুলি প্রকৃতির অপূর্ব জায়গায় স্থাপিত; অমরনাথ কেদার বদ্রী গঙ্গোত্রী  মণিমহেশ হেমকুণ্ড  গোয়ার কিছু গির্জা বা কাশ্মীরের  হজরতবাল মসজিদ  ---সবের পথের শোভা অসাধারণ। সেই পথের  সৌন্দর্যের টানেই ছুটে যাই; দেব দেবীর টানে নয় । কোনো মন্দির মসজিদ গির্জায় বিশেষ স্থাপত্য না থাকলে সাধারণত ঢুকিনা।  যারা প্রচুর পূজা আর্চা করে তাদের অধিকাংশই  গ্রাম ছেড়ে বেরোতে  পারেননি।যারা বেশী  পূজা করে বেশী  নামাজ পড়ে  তাদের দেখেছি অধিকাংশই অসৎ । আবার পাড়ায় অনেককে দেখেছি যারা সারা জীবন ধরে পুজো আর্চা নিয়ে আছে এবং সৎ জীবনযাপন করে তারা গরীব খেতে পায়না  এবং তারা কোনোদিন গ্রামের বাইরে বেরোতে পারেনি। তাহলে এই পূজা প্রার্থনার নীটফল কি শূন্য নয়??

                   কোন ধর্ম পালন না করেও মানুষ সৎ ভাবে বাচতে পারে । অনেক লোককে দেখেছি ধর্মের ধ ও মাথায় না তারা ভীষণ সৎ। আমি কোন ধর্মেই বিশ্বাস করিনা এবং ধার্মিকদের সঙ্গ এড়াই ও পারলে বিরোধীতা করি। বাষট্টি বছর পর্যন্ত লড়াই করে বেঁচে আছি  এবং ভালোই বেঁচেছি, অন্যদের থেকে খুব একটা খারাপও নেই। রোগের কথা যদি বলেন  তবে বলব যারা প্রচুরপূজা আর্চা করে তাদের ঘরে  টিভি ক্যান্সার হয় কেন??। প্রকৃতির সৃষ্ট  মানুষ  আমি প্রকৃতি প্রদত্ত হাত পা মগজ দিয়ে আমার দৈনন্দিন জীবন অতিবাহিত করে বেঁচে থাকার  চেষ্টা করছি।  চেষ্টা করি সবার পাশে থাকার আর কি? এভাবে চলে গেলেই হয়।

পরিবার ও সমাজের চাপেই মানুষ ধর্মে প্রবেশ করে -
শম্ভুনাথ চার্বাক
Nov. 20, 2024 | সচেতনতা | views:815 | likes:2 | share: 2 | comments:0

নাসিরুদ্দিন শা অনুপম খের এর অভিনীত বিখ্যাত এ ওয়েডনেসডে চলচ্চিত্রে পরিচালক নাসিরুদ্দিনের মুখ দিয়ে তোতলামো করিয়ে বলিয়েছিলেন “ WE ARE RELIGIOUS BY FORCE “।কারণ ভারতবর্ষের রাজনৈতিক অবস্থা ধর্মের সুড়সুড়ি ক্রমশ বাড়ছিল। এখনতো একথা বললে সিনেমার সেট পুড়িয়ে দেওয়া হবে। কোন ইসলামিক দেশে এর আসেপাশে কোন কথা বললে তার মুন্ডুর দাম দশ লক্ষ ডলার ধার্য হবে।মহম্মদের ছবি আঁকার জন্য যদি কয়েকশ প্রাণ নিতে পারে ইসলাম ; বিনা কারণেই ব্লাশফেমি চার্জ এনে বধ্যভূমিতে হাজির করবে। 

পরিবার সমাজ বাধ্য না করলে আমরা অনেকেই ধার্মিক হতাম না , আর বিজ্ঞানের যুগে ধর্ম পালন করলে লোকে পাগল বলতো ----- এটা কি মিথ্যা ? শিশুর জন্মের পরেই পরিবার ও সমাজ কি বাধ্য করেনা ধর্মাচারণ করতে ? আমরা ছোটবেলা থেকেই বাবা –মা বা অন্য পরিজনেরা মন্দিরে নিয়ে গিয়ে মাথা ধরে ঠুকে বলে নম করো বা মসজিদ গির্জায় নিয়ে গিয়ে আল্লা যীশুর নামে প্রেয়ার করায় না কি ? এবং শিশুর মনও পরিবারের সেই ধর্মের আদলে গঠিত হতে থাকে ধর্মে ঢোকানোর জন্য ব্যক্তি পরিবার সমাজ ও শাসক বরাবর সক্রিয়। ফলে প্রচুর ধর্মানুষ্ঠান আর আচারের নিগড়ে বাঁধা প্রতিটি মানুষকে। সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে প্রচার ও ধর্ম প্রসারের সহায়ক। নাস্তিকদের চ্যানেলের অনুমতী কি সরকার দেবে ?

। নিজে থেকে কোন মানুষ ধর্মে প্রবেশ করেনা। একমাত্র বুদ্ধিমান মানুষই ধর্মাচারণ করে , অন্য কোন প্রাণী এই গ্রহে ধর্মাচারণ করেনা। সুন্দরবনে হিন্দু বাঘ বা মুসলমান বাঘ নেই কিন্তু হিন্দু মুসলমান মানুষ আছে।এবং আমাদের বৈদিক ধর্মের এক করুণ পরিণতি মানুষের বর্ণ বিভাগ। সুন্দরবনে ব্রাহ্মণ বাঘ বা চারাল বাঘের সন্ধানও কেউ পায়নি। বৃত্তি বিভাজনকে চালাকি করে বর্ণ বিভাজনে পরিণত করে ধর্মের মোড়কে হাজার হাজার বছর ধরে শোষণ করার করুণ পরিণতি আমাদের দেশেই ঘটেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই বৃত্তি বিভাজন হয়েছে উৎপাদন বাড়ানোর তাগিদেই , ইংল্যান্ডেও পটার( কুমোর) , বুচার( কষাই) , স্মিথ (কামার) বারবার ,মিলার প্রভৃতি পদবি আছে। এরা ধর্মতত্ত্ব( থিওলজি বিষয়ের পাঠ্য ) পাস করলেই গির্জার যাজক হতে পারে , কিন্তু ব্রাহ্মণের বাইরে কেউ পুরোহিত হতে পারে এই দেশে ? এখন ধর্মান্তরকরণ ও আন্দোলনের ঠেলার ভয়ে কিছু কিছু পরিবর্তন আসছে। নারীরাও পুজো করছে কলকাতায়। কিন্তু পুরোহিত দর্পণের শূদ্রাচমন আর নারী বিরোধী কথাগুলিতো এখনো গমগমিয়ে চলছে।পুরোহিত দর্পণের শূদ্র ও নারীদের এই অপমানগুলিকে বাদ দেবেন কি করে ?? ব্রাহ্মণ ও ধর্ম বিরোধী আন্দোলন আরো ব্যাপৃত হলে হয়তো ধর্ম ও ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য এগুলিকেও এক সময় বাদ দিতে হবে। এবং আশ্চর্যের বিষয় যাদের এগুলি দ্বারা অপমান করা হয়ে থাকে তারা অর্থাৎ শূদ্র ওনারীরাই এই ধর্মকে আরো বেশী করে আঁকড়ে ধরে সমাজে সঞ্চালিত করে। 

আমি এটা লেখার তাগিদ অনুভব করেছি এক মনস্তাত্বিক প্রক্রিয়া ও দীর্ঘদিনের পর্যবেক্ষণ থেকে। আমার পর্যবেক্ষণ এই যে, গোঁড়ামি ও অন্ধবিশ্বাস একজন মানুষের কাণ্ডজ্ঞান ও বিশ্লেষণী চিন্তাভাবনার ক্ষমতাকে নষ্ট করে দিতে পারে। তাই আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় সত্য অসত্য প্রবন্ধে লিখেছিলেন একজন অধ্যাপক ক্লাশে সূর্য গ্রহণ ও চন্দ্র গ্রহণের কারণ পড়িয়ে সারাদিন নিরম্বু উপবাস থেকে সন্ধ্যায় গ্রহণ ছাড়লে কীর্তনের দলের সাথে গঙ্গায় ডুব দিয়ে পবিত্র হয়ে আসেন। আমরা জানি শিশুকালে সামাজিকীকরণের সময় আমাদের মনে যেসব ধারণা প্রবিষ্ট করানো হয় তা পরবর্তীতে সবসময় আমাদের চিন্তার পটভূমিতে থাকে। ফলে যেকোন অযৌক্তিক ভাবনা চিন্তা যদি আমাদের মনে আসে তবে আমাদের শিশুকালে লব্ধ ভাবধারণার সাথে মিলিয়ে তার বৈধতা দিতে চাই।স্বল্প কিছু বিরল ব্যক্তি ছাড়া অনেক বিদ্বান অধ্যাপক বিজ্ঞানী ইঞ্জিনিয়ার ডাক্তারও এই প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠতে পারেননা। অযৌক্তিকতা ও কাল্পনিক ভাবনাকে বাস্তব বলে গ্রহণের জন্য প্রায়শই তাঁরা সাধারণ জ্ঞান ব্যবহার করেননা অথবা করলেও তখনই করেন যখন তা তাঁদের মনে প্রোথিত ধারণার সাথে খাপ খেয়ে যায়। আর তাই ধর্মপ্রাণ টলেমি পৃথিবী সূর্য চারদিকে ঘোরে বুঝেও নিজের মধ্যেই চেপে রেখে দিলেন বা আমাদের ইসরোর ডিরেক্টর ডঃঃ শ্রীনিবাস চন্দ্রযান উৎক্ষেপণের আগের দিন তিরুপতি মন্দিরে পূজা দিয়ে আসেন এবং চন্দ্রযান ছড়ার আগে নারকেল ফাটিয়ে পূজা করেন , কোপার্নিকাস তাঁর তত্বপ্রকাশ করেননি খ্রিস্টান যাজকদের ভয়ে বা এই বিশ্বাস থেকেই। এই বিশ্বাস এক ভাইরাসের মতো তা সমগ্র জাতিকে ধ্বংস করে দেয়। বিপরীত দিক দিয়ে বলা যায় এই মানবজাতিই পর্যবেক্ষণ এবং নায্য বিচার বিবেচনার অধিকারী। মানুষ তার এই জ্ঞানের জন্য নানা ধরণের বৈজ্ঞানিক সমস্যা সমাধান করতে পারে এবং ভয় ঠেলে সত্য প্রকাশ করতে পারে এবং তাই আমরা পাই গ্যালিলিও ও তাঁর অনুসারীদের। কিন্তু যখন ধর্ম ও রাজনীতির মিশেল সামনে আসে তখন মানুষ তার বিচার-বুদ্ধি , বিশ্লেষণী চিন্তা এবং যৌক্তিকতাকে পদ দলিত করে ফেলে ভয়ে বা অন্ধ ভক্তিতে। 

যুক্তি বিজ্ঞান এবং গণিত অনুযায়ী এই ব্রহাণ্ডের প্রাকৃতিক এবং রাজনৈতিক সামাজিক ---- প্রতিটি ঘটনার পেছনেই কার্যকারণ সম্পর্ক আছে। তবে সমাজবিজ্ঞান ভৌত বিজ্ঞানের ওপর নির্ভর করলেও ভৌতবিজ্ঞানের রিজিড নিয়ম ধরে চলেনা। পৃথিবীর সবচেয়ে নবীনতম প্রাণী মানুষের বয়স কম এবং জ্ঞান বুদ্ধি সেই পর্যায়ে না যাওয়ার জন্য সমস্ত ঘটনা তারা বিশ্লেষণ করতে এখনও সক্ষম নয়।তবে জ্ঞানের প্রসার অনেক দূর গেছে সেটা বুঝতেই পারা যায় বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার প্রভূত অগ্রগতি দেখে। অনেক সময় এই কারণ প্রতীয়মান হয় দ্রুত আবার অনেক সময় তা দীর্ঘকাল নেয়।যেমন ক্যানসারের এখনো ঔষধ বা চিকিৎসা সেভাবে হয়না। তাই প্রতিটি মানুষকে আমরা যুক্তিবাদী হতে বলি বিশ্বাসের ভাইরাসে আক্রান্ত হলে তা কুঁড়ে কুড়ে খায় সমজ ও ব্যক্তি জীবনকে।এবং সমাজের অধিকাংশ মানুষ কষ্টভোগ করে।

বিদ্যাসাগর পরবর্তী যুক্তিবাদী আন্দোলন মুখ থুবড়ে পড়ল কেনো? -
শম্ভুনাথ চার্বাক
Nov. 20, 2024 | যুক্তিবাদ | views:489 | likes:2 | share: 2 | comments:0

বাংলাদেশে ধর্মের বিবর্তন বারবার ঘটেছে। প্রথমে আর্য আগ্রাসন এবং পরবর্তীতে বৌদ্ধ ধর্মের বিস্তার।  শশাঙ্কের নির্মম  হাত ধরে আবার হিন্দু ধর্মের উত্থান, শৈব  শশাঙ্ক অধিকাংশ  বৌদ্ধ মঠ গুঁড়িয়ে দিয়েছিল।পাল রাজাদের সময়ে আবার বৌদ্ধ ধর্মের বিস্তার, কিন্তু সেন রাজাদের হাতে পুনরায় হিন্দু ধর্মের উত্থান বাংলা দেখেছে। হিন্দু বৌদ্ধ বৈষ্ণব ইসলাম  খ্রিস্টান ধর্মের জাতাকলে বাংলায় রক্ষণশীল ধর্ম মতের জয়জয়কার ঘটেছে।      

পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই বিভিন্ন আন্দোলনের প্রাথমিকভাবে নেতৃত্বে থাকে মধ্যবিত্তেরা। ইংরেজ আগমনের পরে  উনবিংশ শতকে বাংলার সামন্তযুগের ভাঙন ও নতুন ধনতান্ত্রিক শিল্প বাণিজ্যের অভ্যুদয়কালে কাঁচামালের উৎপাদকের সাথে শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে  শ্রমবিভাগের ফলে বিচ্ছেদ ঘটে এবং নগরে শহরে শিল্পবাণিজ্য কেন্দ্রীভূত হতে থাকে। তার ফলে সমাজে এক সুসংবদ্ধ মধ্যবিত্ত জনস্তরের বিকাশ হয়। এই মধ্যবর্তী জনস্তরে ধীরে ধীরে যখন নাগরিকতার বিকাশ হয়, তখন সামাজিক ও রাষ্ট্রিক অধিকারের চেতনাও তাদের মধ্যে জাগ্রত হয়। এই মধ্যবর্তী শ্রেণি থেকেই রামমোহন ডিরোজিও বিদ্যাসাগরেরা নেতৃত্ব দিয়েছেন বাংলার নবজাগরণের। রামমোহনের সতীপ্রথা রদ ও ইংরাজীর মাধ্যমে  পাশ্চাত্য শিক্ষার জন্য প্রচেষ্টা সেই সময় বাংলায় এক নতুন দিগন্তের সূচনা করে। এবং পরবর্তীকালে বিদ্যাসাগরের নেতৃত্বে  বিধবা বিবাহ আন্দোলন প্রথম সর্বভারতীয় আন্দোলনের  রূপ নেয় এবং পরবর্তীকালে বাল্য বিবাহ রদ, বহুবিবাহ বন্ধ, নারী শিক্ষা বিস্তার সহ সামগ্রিক শিক্ষার বিস্তার, কলেজ প্রতিষ্ঠা, পাঠ্যপুস্তক রচনা, বাংলা ভাষা ও গদ্যে প্রাণ সঞ্চার, বিজ্ঞান শিক্ষার ব্যবস্থা,  পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের মিলনের শিক্ষা বিস্তার  করা সহ সমস্ত কাজ সমাজে এক বিপ্লব এনে দিয়েছিল। রামমোহন দেবেন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠিত  ব্রাহ্ম্যদের একেশ্বরবাদের আন্দোলন ও পাশ্চাত্য ভাবধারার বিস্তারও সমাজে প্রভাব বিস্তার করেছিল। কিন্তু রামমোহনের পরবর্তীকালে ব্রাহ্মরা সমাজের উচ্চবিত্তদের মধ্যেই এই ধর্মকে রেখে দিলেন, সাধারণ বঙ্গ সমাজে এর বিস্তার ঘটালেন না। নারী শিক্ষার ব্যাপারেও তারা ছিলেন সংকীর্ণমনা, নিজেদের বাড়ীর মহিলাদের শিক্ষার জন্য অন্তঃপুরের  অবরোধের বাইরে বার করেননি। বাল্য বিবাহের বিরুদ্ধেও এরা গেলেননা । এই ব্রাহ্মরা যেন ফিসফাস করে সংস্কারের কাজ করতে উৎসাহী, সেভাবে কেউ এগিয়ে এলেননা। ফলে এই ব্রাহ্মধর্ম সাধারণের মধ্যে প্রসার পেলোনা। 

    হেনরী লুই ভিভিয়ান  ডিরোজিও ছিলেন  ঝড়ের পাখির মতো, স্বল্প কালের জন্য এই পৃথিবীতে এসেছিলেন এবং বাংলার সমাজ জীবনে ঝড়ের পাখির মতো উত্থান হয়েছিল তাঁর আবার ঝড়ের পাখির মতো মিলিয়ে গেলেন এই পৃথিবী ছেড়ে। এই স্বল্প কালে  ইয়ং বেঙ্গলের মাধ্যমে শিক্ষা ও সমাজ সম্পর্কে নতুন ভাবনা বঙ্গের যুবকদের  মাথায় গুঁজে দিয়েছিলেন।এর ফসল ইয়ং বেঙ্গল এবং তাদের মাধ্যমে সংস্কার।

  নবযুগের বাংলায় সমাজ জীবনের স্রোত দুটি স্বতন্ত্রমুখী খাতে প্রবাহিত হয়।একটি সম্মুখগামী উদারপন্থী  উন্নতিশীল ধারা, আর একটি পশ্চাদগামী হিন্দুভাবধারী রক্ষণশীল ধারা। এবং আশ্চর্যের বিষয় জীবন  এই স্রোতের দুটি ধারার মধ্যে ব্রিটিশের চাটুকার  শোভাবাজার রাজবাড়ীর নেতৃত্বে চরম রক্ষণশীল পশ্চাদগামী ধারা সব সময়ই বাংলাদেশে অতীব শক্তিশালী ছিল। এই বাড়ি থেকেই সমস্ত অন্ধবিশ্বাস কুসংস্কার সীলমোহর পেত। ১৮৭০ সালের পর থেকে জাতীয়তাবোধের প্রথম উদ্বোধনকালে তারা অত্যন্ত উগ্রভাবে ঐতিহ্যবাদী হয়ে ওঠেন। এইসব কারণেই এই সময় প্রাচীন আদর্শ ও ঐতিহ্যের পুনরুদ্ধার – আন্দোলন প্রবল হয়ে ওঠে, এবং স্বভাবতই তা মধ্যে মধ্যে বাঁধ ভাঙার উপক্রম করে। বৈদেশিক পরাধীনতার জন্য বাংলাদেশে ধনতন্ত্রের যুগসম্মত স্বাভাবিক বিকাশ সম্ভব হয়নি বটে, কিন্তু ধনতন্ত্রের  এই অসমবিকাশের মধ্যে অর্থনৈতিক  বাস্তব ভিত্তি  রচিত না হওয়ার ফলে চিত্তবিকার ও বিভ্রমই বৃহত্তর সত্য হয়ে উঠেছে এবং নবযুগের নবজাগরণ রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দের উত্থানে প্রহসনে পরিণত হয়েছে। ইউরোপে স্টুয়ার্ট মিল, ডারউইন, কার্ল মার্ক্স ও অন্যান্য মনীষীদের উত্থানে ইউরোপীয় চিন্তাধারাকে প্রবলভাবে আলোড়িত করে তোলে। সে সময় প্রথম পর্বে বিদ্যাসাগরের নেতৃত্ব সমাজকে অনেকটা এগিয়ে দিয়েছিলেন এবং পরবর্তী পর্বে ১৮৬০-৬১ থেকে ১৮৭০-৭২ পর্যন্ত নেতৃত্বে ছিলেন কেশবচন্দ্র সেন।  

           কেশব চন্দ্র সেন বিধবা বিবাহ আন্দোলনের সময় চিৎপুরের গোপাল মল্লিকের বাড়িতে নিজের প্রযোজনায় বিধবা বিবাহ নাটক মঞ্চস্থ করেন  এবং বিদ্যাসাগর তা দেখতেও যান। যে সময় বাংলার গৃহবধূরা অবরোধে কড়া প্রহরায় অন্তরীণ থাকতো সেসময় কেশবচন্দ্র সেন কোলকাতার রাস্তায় সস্ত্রীক এসে দাঁড়ালেন এবং দেবেন্দ্রনাথের ব্রাহ্ম ধর্মের  আচার্য পদে অভিষেক দেখতে জোড়াসাঁকো গেলেন। এটাকে তৎকালীন ভারতীয় সমাজে এক বিপ্লব বলেই চিহ্নিত করা হয়। এটা বন্ধ করার জন্য কেশব সেনের আত্মীয় ও সমাজের রক্ষণশীল নেতারা তাঁর বাড়িতে গুণ্ডা পর্যন্ত পাঠায়, কেশব সেন সেগুলিকে উপেক্ষা করেই স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে জোড়াসাঁকো যান। এই ঘটনার পরে ব্রাহ্ম্যরা তাদের স্ত্রীর সাথে বেরোতে শুরু করেন এবং পরে তা হিন্দু  সমাজেও তা প্রচলিত হয়। কেশবচন্দ্রের উত্থানকে বাংলার ব্রাহ্ম্য সমাজের নবোত্থানের যুগ বলে উল্লেখ করা হয়। কেশবচন্দ্র ব্রহ্ম্যবিদ্যালয়, সঙ্গতসভা, কলিকাতা কলেজ  প্রতিষ্ঠা করে বাংলার শিক্ষিত তরুণ সমাজকে ব্রাহ্ম্য ধর্মের দিকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করেন। এই সময় তিনি সুবক্তা,পুস্তিকা লেখক, সংস্কারকর্মী, ধর্ম প্রচারক ও মানবহিতৈষী বলে সমাজে খ্যাতি লাভ করেন। ১৮৬০  --১৮৭২ সাল পর্যন্ত কেশব সেনের জন্য বাংলার সমাজ জীবন প্রব; আলোড়িত হয়। কেশব সেন বিদ্যাসাগরের একান্ত অনুগামী। তাঁর জন্যই ব্রাহ্ম্যধর্মের আচার্যদের ব্রাহ্মণ্যত্বের সনাতন প্রতীক উপবীত বা পৈতা  ত্যাগের কথা বললেন। দেবেন্দ্রনাথ অনিচ্ছা সত্বেও তরুণদের এই প্রস্তাবে রাজী হলেন। ব্রাহ্ম্যধর্মে অসবর্ণ বিবাহ শুরু হলো ১৮৬২ সালে। দেবেন্দ্রনাথ কিন্তু অসবর্ণ বিবাহ মনে মনে স্বীকার করতেননা। ব্রহ্মোপাসনার সময় পুরুষদের সাথে মেয়েদেরও যোগ দেওয়ার অধিকার থাকবে। এইসব সংস্কার প্রাচীনপন্থী দেবেন্দ্রনাথ সহ্য করতে পারেননি, ফলে ব্রাহ্ম্য সমাজ দুভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। ১৮৭০ এর ফেব্রুয়ারীতে কেশবচন্দ্র ইংল্যান্ড যাত্রা করেন র প্রতিভায় ও বাগ্মিতায় ইংরেজ সমাজ মুগ্ধ হয়ে গেল। সেখানে জনসাধারণের আত্মোন্নতির ও আত্মপ্রতিষ্ঠার অদম্য আগ্রহ এবং শ্রমিক শ্রেণির সচেতন আন্দোলন তাঁর উপর গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল।১৮৭০ এর শেষে কলকাতায় ফিরে এসে ভারত সংস্কার সভা, স্থাপন করেন। এদের কর্মসূচী ছিল সুলভ সাহিত্য প্রকাশ,সুরাপান নিবারণ, শ্রমজীবী বিদ্যালয় স্থাপন, স্ত্রী-শিক্ষা প্রসার, দান-দাতব্য সভা।

              কিন্তু ক্রমে ক্রমে কেশবচন্দ্রের চিন্তাধারা ও কাজকর্মে নানারকমের অসঙ্গতি দেখা যায়। তিনি গণতান্ত্রিক ভাবধারার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেই তিনিই এর বিরোধীতা শুরু করলেন।অল্পদিনের মধ্যেই ঈশ্বরপ্রেরিত মনুষ্যাবতার সম্বন্ধে তাঁর গভীর বিশ্বাস জন্মালো, সে বিষয়েও তিনি আবেগময়ী বক্তব্য রাখা শুরু করলেন এবং নিজেকে অবতার বলে ভাবতে শুরু করলেন। কেবল অবতারবাদ নয়, বৈষ্ণব ভক্তিবাদও তাঁকে আচ্ছন্ন করে ফেললো। বৈষ্ণব পরিবারের সন্তান শেষ পর্যন্ত খোল-করতাল সহ নগরকীর্তনে বেরোতে শুরু করলেন। নিজেকে অবতার বলে ভাবতে শুরু করলেন। ১৮৭৬ সালে রামকৃষ্ণর সাথে দেখা হতে তিনি মাতৃভাবে উদ্ভ্রান্ত হয়ে পড়লেন এবং ব্রাহ্ম্যধর্ম হিন্দু ধর্মের মধ্যে লুপ্ত হয়ে গেল। ১৮৭২ সালে তিনি নিজের নাবালিকা কন্যা সুনীতিদেবীর কুচবিহারের মহারাজা নৃপেন্দ্রনাথের সাথে হিন্দুমতে বিবাহ দিলেন। যত তাড়াতাড়ি প্রদীপ শিখা প্রজ্জ্বলিত হয়েছিল তত দ্রুত প্রদীপ নিভে গিয়েছিল। কেশবচন্দ্র ও অনেকটাই দায়ী বাংলার যুক্তিবাদী আন্দোলন বিস্তার না হওয়ার। কেশবচন্দ্র ও তাঁর অনুগামীরা সব দক্ষিণেশ্বরে দৌড়তে শুরু করলো এবং ব্রাহ্ম্য ধর্মকে হিন্দু ধর্মের সাথে মিলিয়ে দিল। এই সময় তরুণ ব্রাহ্ম্যরা সমাজ থেকে বেরিয়ে  সমদর্শী নামে একটি দল গঠন করেন। শিবনাথ শাস্ত্রী, আনন্দমোহন বসু,দুর্গামোহন দাস, দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় এই দলের নেতৃত্বে ছিলেন। শিবনাথ শাস্ত্রী ছিলেন এদের নেতা, তিনি পুনরায় ব্রাহ্ম্যসমাজকে যুক্তিবাদ, ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ ও গণতন্ত্রের ওপর প্রতিষ্ঠা করেন এবং সাধারণ ব্রাহ্ম্যসমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। 

সূত্রঃ বিদ্যাসাগর ও বাঙালি সমাজ - বিনয় ঘোষ

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929